Published in বণিকবার্তা on Wednesday, 3 October 2018
বিলসের পর্যালোচনা: পোশাক শ্রমিকের বেতনে কমছে মূল মজুরির অংশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
যেকোনো বেতন কাঠামোতে শ্রমিকের প্রাপ্য ভাতা ও সুবিধাগুলো নির্ভর করে মূল মজুরির ওপর। দেশে চামড়া, জাহাজভাঙা, নির্মাণ শিল্পসহ কয়েকটি খাতের শ্রমিকের নির্দিষ্ট মজুরি কাঠামো রয়েছে। দেখা গেছে, রফতানি আয়ে শীর্ষে থাকা পোশাক শিল্পের শ্রমিকরাই অন্যান্য খাতের শ্রমিকের তুলনায় মূল মজুরি কম পাচ্ছেন। খোদ পোশাক খাতের মজুরি কাঠামোতেও শ্রমিকের মূল মজুরি বিগত সময়ের তুলনায় ক্রমশ কমছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পর্যালোচনায় উপরের তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে। গতকাল রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার ভবনে আয়োজিত ‘তৈরি পোশাক শিল্পে ঘোষিত নিম্নতম মজুরি: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিলসের পর্যালোচনাটি উপস্থাপন করা হয়। এ সময় ঘোষিত মজুরি হারের যৌক্তিকতা, পদ্ধতি ও বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও মতামত জানান উপস্থিত শ্রমিক প্রতিনিধিরা।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর পোশাক শিল্প শ্রমিকদের নিম্নতম ৮ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে নিম্নতম গ্রেডে মূল মজুরি ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১০০ টাকা। ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঘোষিত পোশাক খাতের মজুরি কাঠামো পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ খাতে শ্রমিকের মূল মজুরির হার ক্রমেই কমছে। পোশাক শিল্পে শ্রমিকের মূল মজুরির পরিমাণও অন্যান্য খাতের তুলনায় সবচেয়ে কম বাড়ছে বলে সাম্প্রতিক সময়ে নির্ধারণ হওয়া বিভিন্ন মজুরি কাঠামো বিশ্লেষণে জানা গেছে।
বিলসের আয়োজনে মজুরি কাঠামো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি প্রেজেন্টেশন পেশ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোস্তাফিজ আহমেদ। এতে তিনি বিগত বছরে ঘোষিত মজুরি কাঠামোগুলোয় মূল মজুরির অংশ তুলে ধরেন। দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে পোশাক শ্রমিকের মূল মজুরি ছিল মোট মজুরির ৬৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০০৬ সালে মূল মজুরি বেড়ে মোট মজুরির ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়। এর পর থেকে ক্রমেই কমছে মূল মজুরির অংশ। ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ঘোষিত মজুরিতে মূল মজুরির অংশ যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ৬৭, ৫৬ দশমিক ৬০ ও ৫১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘোষিত চামড়া, নির্মাণসহ ১৬টি খাতে শ্রমিকের মূল মজুরি মোট মজুরির ৫৪ দশমিক ৬৯ থেকে ৬৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি বছর পোশাক খাতের শ্রমিকদের মোট মজুরিতে মূল মজুরির অংশ হয়েছে ৫১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
বিলস ভাইস চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান ভূঞার সভাপতিত্বে বৈঠকে জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল, মজুরি বোর্ডের শ্রমিকপক্ষের সাবেক প্রতিনিধি, গবেষক, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সঞ্চালনা করেন বিলসের যুগ্ম মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক মো. জাফরুল হাসান।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি কামরুল আহসান, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল সভাপতি আনোয়ার হোসাইন, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স লীগের সভাপতি জেডএম কামরুল আনাম, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ প্রমুখ।
আমিরুল হক আমিন বলেন, ২০১৩ সালে মূল মজুরি বেড়েছে ৫৬ শতাংশ, যা সবচেয়ে কম। আমরা নিম্নতম গ্রেড নিয়ে আলোচনা করলেও অন্যান্য গ্রেড নিয়ে আলোচনা করি না। মূল মজুরি বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। মূল মজুরির ওপর অন্যান্য সুুবিধা বৃদ্ধি নির্ভর করে। তাই মূল মজুরিকে মানসম্মত পর্যায়ে নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মূল মজুরি ৭০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে।
জেডএম কামরুল আনাম বলেন, মজুরি রিভিশনে কোনো সংগঠন পিটিশন করেনি। ৬০ থেকে ৭০ ভাগ শ্রমিক অপারেটর। তাদের মজুরি বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি দরকার। এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়টি উপস্থাপনের সুযোগ রয়েছে।
সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, মূল মজুরি না বাড়লে ন্যূনতম মজুরিকে সুবিধাজনক পর্যায়ে নেয়া যাবে না। বুলগেরিয়ার মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে পোশাক শ্রমিকের মজুরি ২০০ ডলার হলেও বাংলাদেশে তা ১০০ ডলারে উন্নীত করা যায়নি। গেজেট ঘোষণার আগে দাবিগুলো তুলে ধরা দরকার।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ১২ শতাংশ শ্রমিক মেঝেতে ঘুমায়। ১৭ শতাংশের বৈদ্যুতিক পাখা নেই। ৮৩ শতাংশকে টয়লেট শেয়ার করতে হয়। ৮৪ শতাংশ শ্রমিক একই রান্নাঘর ব্যবহার করে। সিপিডি প্রস্তাবিত মোট মজুরি ছিল ১০ হাজার ২৮ টাকা, মূল মজুরি ৫ হাজার ৬৭০। শ্রমিকের সঞ্চয়ের প্রস্তাবও ছিল। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে উপরের গ্রেডে যেন মজুরি সুষমভাবে বৃদ্ধি হয়। গ্রেড ৮ রয়েছে শিক্ষানবিশ। এ গ্রেডটি থাকার দরকার আছে বলে মনে হয় না। শ্রমঘন এলাকায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধি হয় তুলনামূলকভাবে বেশী। এক্ষেত্রে বাড়িওয়ালাকে ঋণ দিয়ে বহুতল করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা যেতে পারে। চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্কুল নির্মাণে এনজিওদের উদ্যোগ নিতে হবে। মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর ব্র্যান্ড বায়ারদের প্রতিক্রিয়া জানা দরকার। পোশাক কেনার মূল্য বৃদ্ধি করে মজুরি বাড়ানোয় ব্র্যান্ডগুলোর কোনো উদ্যোগ থাকবে কিনা দেখতে হবে। মজুরি বোর্ডের অবস্থান ও কাঠামো নিয়ে দুর্বলতা রয়ে গেছে।
রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, শ্রমিকের বেতন বেড়েছে ৮ গুণ, রফতানি বেড়েছে ৯৮৭ গুণ। কম্বোডিয়ায় মজুরি বেশি। আমাদের সে তুলনায় কম। বিষয়টি মাথায় নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। ভেতরের দুর্বলতা কমানো ও বাইরের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে।