Originally posted in The Business Standard on 18 December 2025
নতুন মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকের পরিকল্পনা, পরিচালিত হবে সামাজিক ব্যবসা মডেলে
চলতি সপ্তাহেই মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করে অংশীজনদের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রবর্তিত “সামাজিক ব্যবসার” ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি বিশেষায়িত ‘মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশের খসড়াও তৈরি করেছে।
প্রস্তাবিত এই ব্যাংকটি প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে ক্ষুদ্র ও উদীয়মান উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে। এর মূল কাঠামোর বিশেষত্ব হলো—ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারাই হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারধারী। পাশাপাশি এই ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর বাইরে পরিচালিত হবে।
নতুন নিয়ন্ত্রক কাঠামো
চলতি সপ্তাহেই মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করে অংশীজনদের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো সব ধরণের আর্থিক সেবা দিলেও মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকের লাইসেন্সিং অথরিটি কিংবা নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্বে থাকবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা—মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ব্যাংকটির লাইসেন্স ও তদারকির দায়িত্ব পালন করবে। এমনকী কোম্পানি অবসায়ন সংক্রান্ত— ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিদ্যমান বিধান এবং অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকিং বিধিবিধান থেকেও এই প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা দেশের প্রচলিত আর্থিক কাঠামোয় একটি বড় ধরনের ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সামাজিক ব্যবসার নীতিতে পরিচালনা
গত ১৭ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। যেখানে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে প্রতিষ্ঠানটি জামানতের বদলে “আস্থা ও বিশ্বাসের” ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে।
তার নির্দেশনার পর এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকিং সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থিকখাতে সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিকে প্রবেশ করার আইনী ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “এর মূল দর্শন হলো—এই ব্যাংক একটি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং ব্যাংকে বিনিয়োগকারী বা পরিশোধিত মূলধনের যোগানদাতারা তাদের বিনিয়োগ করা মূলধনের অতিরিক্ত মুনাফা নিতে পারবেন না। বাড়তি মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে করপোরেট ও সর্বোচ্চ মুনাফাভিত্তিক প্রচলিত মডেলের একটি বিকল্প কাঠামো গড়ে উঠবে।”
কার্যপরিধি ও মূলধন কাঠামো
খসড়া অধ্যাদেশে প্রস্তাবিত মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকের বহুমুখী কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
#ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সরবরাহ: ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ
#ভৌত সম্পদ সরবরাহ: শিল্প ও কৃষিযন্ত্র, গবাদিপশু এবং কাঁচামাল ঋণের মাধ্যমে সরবরাহ
#সমন্বিত সহায়তা: কারিগরি, প্রশাসনিক ও বিপণন পরামর্শের পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের জন্য বীমা সুবিধা
#সঞ্চয় ব্যবস্থাপনা: ঋণগ্রহীতা ও সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ
প্রস্তাবিত ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা, যা ১০০ টাকা মূল্যমানের তিন কোটি শেয়ারে বিভক্ত থাকবে। এর প্রারম্ভিক পরিশোধিত মূলধন হবে ১০০ কোটি টাকা। ব্যাংক পরিচালনার জন্য সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ থাকবে, যার মধ্যে ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডার মনোনিত তিন জন পরিচালক এবং অন্যান্য শেয়ারহোল্ডার মনোনিত তিনজন পরিচালক থাকবেন।
উদ্বেগ যেখানে
তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা) তৌফিকুল ইসলাম খান এ উদ্যোগ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, যে ধরণের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলোই গ্রামীণ ব্যাংকসহ মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো করতে পারে।
তার মতে, নতুন ব্যাংক গঠনের পরিবর্তে বিদ্যমান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে আরও শক্তিশালী করে পর্যায়ক্রমে এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা বিস্তৃত করাই বেশি যৌক্তিক হতে পারে।
মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ করার জন্য দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অবস্থায় দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন একটি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করলে তা বাজারে চরম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে।
”সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আছে। এই সরকার অধ্যাদেশ জারি করলেও নবগঠিত ব্যাংকটি রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদে অপারেশনাল হবে। তাই এই সময়ে নতুন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি নেওয়ারও প্রয়োজন আছে”- যোগ করেন তৌফিকুল।
মাইক্রোক্রেডিট খাতের বর্তমান চিত্র
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি গত জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, বর্তমানে দেশে ৭২৪টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান মোট ৪ কোটি ১৬ লাখ সদস্যকে সেবা দিচ্ছে, যার মধ্যে ৩ কোটি ২২ লাখ ঋণগ্রহীতা। এটা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বড় অবদান রেখেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ২ লাখ ২৩ হাজারের বেশি কর্মী এবং সারা দেশে রয়েছে ২৬ হাজার ৭১টি শাখা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা, এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ঋণ বিতরণ হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, যার প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষিখাতে প্রান্তিক পর্যায়ে বিতরণ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে দেওয়া বাণীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো মাইক্রোফাইন্যান্স খাতে ৫ লাখ ৬০ হাজার সদস্য ও ৪ লাখ ঋণগ্রহীতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবস্থাপিত ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, সঞ্চয় ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা এবং মোট ঋণ বিতরণ ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।



