Originally posted in কালের কন্ঠ on 19 May 2022
ডলারের অস্থিরতা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত
আন্ত ব্যাংকে মার্কিন ডলারের দাম আরো ১০ পয়সা বেড়ে সর্বোচ্চ ৮৭ টাকা ৬০ পয়সা দরে বিক্রি হয়েছে গতকাল। ফলে ব্যাংকগুলোতেও ডলারের দাম বেড়েছে। আর খোলাবাজারে সর্বোচ্চ ১০৩ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে ডলার। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে নগদ ডলারের দাম।
গতকাল নগদ প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৯২ থেকে ৯৭ টাকা দরে। আমদানির জন্য বিক্রি হয়েছে ৮৭ টাকা ৬০ পয়সা দরে। মানিচেঞ্জারগুলো প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১০১ থেকে ১০২ টাকা করে। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১০২ থেকে ১০৩ টাকা করে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুদ্রাবাজারে যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা সুস্থির অবস্থায় নিতে হলে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে টাকার আরো অবমূল্যায়ন এবং রিজার্ভ থেকে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম থাকায় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত আন্ত ব্যাংক হারও অকার্যকর হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বাজারে বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন শীর্ষ নির্বাহী বলেন, এটা কিছুটা সত্য, কিছু ব্যাংক ডলারসংকটের সুযোগ নিয়ে মুনাফা করছে। ছোট রপ্তানিকারকরা, যাঁদের দর-কষাকষির ক্ষমতা নেই, তাঁরাই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁর মতে, বর্তমান অন্যায্য অনুশীলন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুদ্রাবাজারে বিক্রি এবং ক্রয়মূল্যের মধ্যে একটি আদর্শ সীমা অবশ্যই থাকা উচিত।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখন নগদ ডলার ৯১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৯৩ টাকা দরে বিক্রি করছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৯৩ টাকা থেকে ৯৭ টাকা দরে বিক্রি করছে। ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রার দামও বেড়েছে। এর মধ্যে পাউন্ড ১২০ টাকা, ইউরো ১০২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর মতিঝিল ব্যাংকপাড়া, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও গুলশানের মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, আগে বিদেশ থেকে প্রবাসীরা যেসব নগদ ডলার নিয়ে আসতেন সেগুলোর একটি অংশ কার্ব মার্কেটে বিক্রি করতেন। সেগুলোই ডলার পাওয়ার তাঁদের প্রধান উৎস। কিন্তু করোনার পর ওই উৎস থেকে ডলার পাওয়া কমে গেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ব্যাংকে ডলারের সংকট হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কার্ব মার্কেটে নজরদারি বাড়িয়েছে। ফলে অনেকেই কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি করতে আসে না। অনেকে বেশি দামের আশায় মানিচেঞ্জারগুলোতে ডলার বিক্রি করছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ডলারের ব্যাংক নির্ধারিত বিনিময়হারের অনেক বেশি দামে কার্ব মার্কেট ও এলসি খোলা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও বেশ বড় পার্থক্য নিয়ে কেনাবেচা করছে। এতে আমদানিমূল্যের ওপর প্রভাব পড়বে। বৈশ্বিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এখন বিনিময়হারের ক্ষেত্রেও যদিও অস্থিরতা চলে তা অর্থনীতির জন্য ভালো বার্তা দেয় না। আস্থার অভাব এবং অনিশ্চয়তায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনিশ্চয়তা যদি আমরা কাটাতে না পারি তাহলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়।
বাজার সামাল দিতে আরো পদক্ষেপ
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমদানির চাপের কারণে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকায় ডলারের দাম বেড়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সরবরাহ করছে। রেটও পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে পণ্য পরিবহন অর্থাৎ জাহাজভাড়াও বেড়েছে। যার কারণে ডলারের সঙ্গে টাকার মানের ব্যবধান বড় হচ্ছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে টাকার মান অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এক ডলারের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা।
তিনি বলেন, ‘চাহিদার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে যেসব ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে তাদের বিষয়টি তদারক করা হবে। কোনো অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। ’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য জারি করা সব আদেশ বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে ও আংশিক অর্থায়নে বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে নিজস্ব অর্থায়নে চিকিৎসা ও হজ পালনের জন্য বিদেশে ভ্রমণ করা যাবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
এর আগে গত সোমবার সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
সার্বিক অবস্থা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আমদানির প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। অন্যদিকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গেছে। যদিও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু আমদানির প্রবৃদ্ধি আরো বেশি। সেখানেও চাপ সৃষ্টি। স্বভাবতই ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, তাই দাম বাড়ছে। এতে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যা আরো বেড়ে যেতে পারে। এতে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের অবস্থা আরো খারাপ হবে।