Originally posted in সময়ের আলো on 14 January 2024
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সবার আগে
নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা। এই খাতে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের ভাষ্যমতে, নতুন সরকারের সামনে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এরপর অস্থির ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনা। আর্থিক খাতের দুরবস্থা, কর কাঠামো ঢেলে সাজানো, ঝিমিয়ে থাকা শেয়ারবাজারে গতি আনা, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ঠিক করাও সরকারের সামনে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন নতুন সরকারের সামনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে সময়ের আলোকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। কোনটা রেখে কোনটা বলব। তবে মোটাদাগে বলতে হয়, সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। দেশে এখন মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। হুট করেই জাদুর কাঠি দিয়ে সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে না। অর্থনীতিতে এর পরের চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ডলার সংকট। ডলারের বাজার এখন রীতিমতো টালমাটাল। ডলারে শৃঙ্খলা না ফেরালে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে।
এরপর সরকারের সামনে কিছু মধ্যমেয়াদি সংকট রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক খাতের দুরবস্থা ঘোচানো, কর কাঠামো ঢেলে সাজানো, ঝিমিয়ে থাকা শেয়ারবাজারে গতি আনা, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ঠিক করা। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হচ্ছে-এসব চ্যালেঞ্জ সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সবার আগে মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক না করে সম্প্রসারণমূলক করতে হবে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের ৯-৬ হার তুলে দিয়েছে, কিন্তু এর সুফল এখনও মেলেনি। নতুন মুদ্রানীতিতে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আর ডলার সংকট দূর করতে বাজারে ডলারের তারল্য বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রথমত রেমিট্যান্স যাতে বাড়ে তার জন্য হুন্ডি বন্ধ করতে হবে এবং ডলারের একটি রেট নির্ধারণ করে দিতে হবে। কেননা ডলারের একেক রেট থাকায় প্রবাসীরা বেশি লাভের আশায় বৈধ চ্যানেলে বেশি রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। বাজারে ডলারের তারল্য বাড়াতে হলে আমদানি-রফতানির আড়ালে যে আন্ডার ইনভয়েস-ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা ও ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেটি ঠেকাতে হবে। এটি ঠেকাতে পারলে রফতানি আয় বাড়বে, টাকা পাচার বন্ধ হবে এবং ডলারের সরবরাহ বাড়বে।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মধ্যমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগের মধ্যে সবার আগে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। খেলাপি ঋণ বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে।
অর্থনীতির এত এত সংকটের মধ্যে নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি অর্থনীতির ছাত্র হলেও পররাষ্ট্র নিয়ে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তিনি কি পারবেন অর্থনীতি চাঙা করতে? এ প্রসঙ্গে ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে অর্থমন্ত্রীকে অর্থনীতির বিষয়েই অভিজ্ঞ হতে হবে বিষয়টি তেমন নয়। অর্থমন্ত্রী মূলত নীতি তৈরি করে দেবেন। এটি করতে অর্থমন্ত্রীকে অর্থনীতিবিদ হতে হবে তা নয়। কারণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বেশির ভাগ কমিটিতে দেশের অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা থাকেন। এখন এ সংকটের সময় জরুরি ভিত্তিতে অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের দিয়ে এসব কমিটি গঠন করে তাদের পরামর্শ নিয়ে অর্থনীতি চাঙা করতে জরুরি নীতি-পরামর্শ দেবেন অর্থমন্ত্রী।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, ‘নতুন সরকারের সামনে অনেক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকার অর্থনৈতিকভাবে কতটা সফল হতে পারবে সেটি নির্ভর করবে চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করে এবং মোকাবিলায় সফল হতে পারে কি না তার ওপর। অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। ২০২৩ সালজুড়েই মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। এ কারণে সারা বছর দেশের মানুষের নিদারুণ কষ্ট হয়েছে। নতুন বছরে এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই হবে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর বাইরে রিজার্ভের অস্বাভাবিক পতন, টালমাটাল ডলারের বাজার, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়া, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে না পারা, সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়া এবং ঋণের সুদ পরিশোধ করাও সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ।’
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বর্তমানে অর্থনীতির গলার কাঁটা ডলার সংকট। দফায় দফায় নানা পদক্ষেপেও ডলার-সংকট কাটাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো তা কমছেই। গত মাসে রেমিট্যান্স বাড়া, আইএমএফের ঋণের কিস্তি, কোরিয়ান ঋণ ও এডিবির ঋণের ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও এটা কত দিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ ছাড়াও নতুন সরকারের সামনে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে অনেক। সেগুলো মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন হবে নতুন সরকারের জন্য।’