মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি প্রয়োজন – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 8 November 2024

খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবারো বেড়ে ১২.৬৬%

শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতি দুই মাস ধরে ঋণাত্মক, বাংলাদেশে আরো বেড়েছে

ছবি : বণিক বার্তা

দেউলিয়াত্ব থেকে ফিরে আসা দ্বীপদেশ শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতি দুই মাস ধরে ঋণাত্মক। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমতে থাকায় দেশটিতে এখন মূল্য সংকোচন দেখা যাচ্ছে।

দেউলিয়াত্ব থেকে ফিরে আসা দ্বীপদেশ শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতি দুই মাস ধরে ঋণাত্মক। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমতে থাকায় দেশটিতে এখন মূল্য সংকোচন দেখা যাচ্ছে। বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। এখানে আরো অবনতি হয়েছে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির। গত মাসে (অক্টোবর) মূল্যস্ফীতি আবারো দুই অংক ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই মূল্যস্ফীতির সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গতকাল প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে। আর সেপ্টেম্বরে এ হার খাদ্যপণ্যে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময় শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির তীব্রতা বেড়েছে। অক্টোবরে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে তা ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলংকা দেউলিয়া হয়ে পড়ে ২০২২ সালের প্রথমার্ধে। ডলার সংকট ও অর্থনৈতিক বিপত্তির প্রভাবে দেশটিতে খাদ্য ও জ্বালানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি জর্জরিত দেশগুলোর একটি হয়ে ওঠে শ্রীলংকা। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ঠেকে ৭০ শতাংশে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে এ বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে থাকে বৈদেশিক দায় পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা দেশটি। নিয়ন্ত্রণে চলে আসে মূল্যস্ফীতি। সর্বশেষ গত দুই মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ঋণাত্মক। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ঋণাত্মক দশমিক ৫ শতাংশ। অক্টোবরে দাঁড়ায় ঋণাত্মক দশমিক ৮ শতাংশে।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি নিত্যপণ্যের শুল্কছাড় এবং বাজার তদারকিতে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর পরও তা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। উল্টো ভোক্তাদের জন্য পরিস্থিতি দিনে দিনে আরো অসহনীয় হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরং এখানে রাজস্বনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্যের সরবরাহ চেইনে শৃঙ্খলা ফেরানোও গুরুত্বপূর্ণ। নইলে শুল্কছাড়ের সুফল ভোক্তার কাছে না পৌঁছে গুটিকয়েক সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকে যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জনও দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চাহিদা সংকোচন করা ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার নেই। কিন্তু এতে কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার তদারকি করা হলেও পদক্ষেপ হিসেবে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। প্রতিনিয়ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। উৎপাদন ও আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে একটি বড় সরবরাহ চেইন রয়েছে। এখানে কিছু অংশগ্রহণকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছে। তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে মূল্যস্তর সহনীয় করা যাবে। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা না বাড়িয়ে শুধু তদারকির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।’

২৮ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ অর্থনীতির বহিঃস্থ উপাদানগুলোকে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসেছে মূলত অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর কারণেই।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর প্রচলিত পথেই হাঁটছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা কম। এ কারণে বাংলাদেশে উন্নত বিশ্বের মতো কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের পাশাপাশি কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা না নিয়ে পণ্যমূল্য নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সেভাবে কার্যকরী হয় না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ২ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। এসব দেশে মুদ্রানীতি ভালোভাবে কাজ করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে আমানত ও ঋণের সুদহার ৬ ও ৯ শতাংশে নির্ধারিত করে রাখা হয়েছিল, যা বাজার ব্যবস্থাপনাকে আরো দুর্বল করে তুলেছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির ব্যবহার এখানে নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এর ফল পেতে সময় লাগবে। তবে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আমাদের ভূমিকা কম। যদি বাজার ব্যবস্থাপনায় তাদের ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণও থাকে, সেটা মোকাবেলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অ্যাডহক ভিত্তিতে হয়তো পণ্যমূল্যের দাম বেঁধে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটি ভুল চিন্তা। বরং সিন্ডিকেট কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোয় জোর দিতে হবে।’

অনেকটা একই অভিমত গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনেরও। যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

বণিক বার্তাকে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারকে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। সাম্প্রতিক বন্যার কারণে বেশকিছু জেলায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজদের এখনো বিতাড়িত করা সম্ভব হয়নি। কৃত্রিম সরবরাহ সংকটের চেষ্টা করা হচ্ছে কিনা, সেটি দেখতে বাজার ব্যবস্থাপনাকে আরো জোরদার করতে হবে। প্রতিযোগিতা কমিশনকে অবশ্যই কার্যকর করতে হবে। সরবরাহ সংকট পূরণে সরকারের এখনই আমদানি বাড়ানো প্রয়োজন। আমদানি পণ্যের ট্যারিফ কমানো উচিত এবং এর সুফল যাতে ভোক্তারা পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আরো বেশি আমদানিকারককে পণ্য আমদানির সুযোগ দিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে বাজার কিছু ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি হয়ে না পড়ে। এছাড়া পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলারের জোগানও নিশ্চিত করতে হবে।’

নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা মূল্যস্ফীতি এখন নীতিনির্ধারকদেরও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। অক্টোবরের মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান প্রকাশের পর গতকালই অর্থ মন্ত্রণালয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অর্থ, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান, অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্যপণ্য আমদানির সুযোগ দেয়া এবং খাদ্য, নিত্যপণ্য ও সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় সাময়িকভাবে একক গ্রাহক ঋণসীমায় ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার নজরদারি বজায় রাখা হলেও এক্ষেত্রে বেশি কঠোর অবস্থানে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, যেটা আমরা ডিমের বাজারে দেখেছি। তাই সরকার বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যাংক খাতের তারল্য প্রবাহে লাগাম টানা হয়েছে এবং এতে করে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এক্ষেত্রে এর সুফল পেতে হলে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে।’

বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় ১০ সদস্যের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে অভিযান। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযানে যুক্ত হচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। নজরদারির পাশাপাশি কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো বাজারে সবজি বিক্রির উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এমনকি নিত্যপণ্যের মূল্যহ্রাসে পেঁয়াজ, চাল, তেল, চিনি, আলু ও ডিমের মতো পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড়ের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে এসব উদ্যোগের সুফল মেলেনি।

এ বিষয়ে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিলেও তার সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। শুল্কছাড় দেয়া হলেও চাল-পেঁয়াজের দাম কমছে না। তাহলে এসব অর্থ কি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাচ্ছে? সরকার পরিবর্তন হলেও সুবিধাভোগীরা আগের মতোই বহাল রয়েছে। অস্থিরতা তৈরির জন্য একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। বাজার তদারকির পদক্ষেপগুলোও দায়সারাভাবে করা হচ্ছে।’

বাজারে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এ অবস্থায় সরকার চাল আমদানিতে শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের পরও পাইকারি বাজারে পণ্যটির দামে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি, উল্টো ১০ দিনের ব্যবধানে মোটা ও মাঝারি চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে। শুল্কছাড় দেয়া অন্যান্য পণ্যের দামও খুব একটা কমতে দেখা যাচ্ছে না।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা অবশ্য বলছেন, মৌসুমি কারণেই এ সময়ে দেশে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে থাকে। তাছাড়া এবারের বন্যাও মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আশ্বিন-কার্তিক মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা বাড়ে। মৌসুমগত কারণেই এ সময়টায় চালের মজুদ কমতে থাকে। সবজির দামও বাড়তি থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে পরপর দুটি বন্যার প্রভাবে এবার সবজি ও চালের উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। ফলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি স্বাভাবিক। এখন বাজারে শীতের আগাম সবজি আসছে। তাই আশা করা যায় নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসবে। ডিসেম্বরে আরো কমবে। আর সরকার এরই মধ্যে চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।’

মূল্যস্ফীতির হিসাবের মধ্যে চালের ভার বা ভিত্তি সবচেয়ে বেশি। তাই চালের দাম বাড়লে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় বেশি। যার প্রভাব পড়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চালের দাম এখনো কিছুটা কম আছে। এরই মধ্যে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে সরকারিভাবে তিন লাখ টন আমদানি করা হবে। এসব চাল আমদানি করা হলে দাম কমে আসবে। উত্তরবঙ্গে আজকে নতুন করে দাম আর বাড়েনি। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বৃষ্টি ও বন্যার প্রভাব থাকতে পারে। এছাড়া দাম বাড়ার বিষয়টি নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা হওয়ায় “প্যানিক বায়িং”-এরও একটি প্রভাব হয়তো আছে।’

শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধি, মুদ্রার বিনিময় হারকে নমনীয় করা এবং কঠোর আর্থিক ও মুদ্রানীতির মতো পদক্ষেপ নেয়ায় এর সুফল মিললেও তাতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আর্থিক ও রাজস্বনীতিতে কৃচ্ছ্র সাধন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি মোকাবেলায় আমদানি উদারীকরণের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে কেবল আমদানি শিথিল করলেই হবে না, এর সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যপণ্যের ওপর শুল্ক কমানোও প্রয়োজন। এছাড়া চাঁদাবাজি বন্ধ করার মাধ্যমে উৎপাদনকারী পর্যায় থেকে বাজার পর্যন্ত পণ্যের অবাধ সরবরাহের বাধা দূর করতে হবে, যা পণ্যের দাম কমাতে সহায়ক হতে পারে।’