Originally posted in বণিকবার্তা on 29 August 2024
দুই বছর ধরেই দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে দেড় দশকের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি রেখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনা সরকারও শেষ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধিকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তাতে সফলতা না এসে উল্টো মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখছে বর্তমান সরকারও। এক্ষেত্রেও প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আবারো বাড়ানো হয়েছে সুদহার। যদিও দেশের গত এক দশকের তথ্য পর্যালোচনা করে মূল্যস্ফীতি বাড়া-কমার ওপর ব্যাংক ঋণের সুদহারের তেমন কোনো সম্পর্কও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় কেবল সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আর সময়মতো সুদহারও বাড়ানো হয়নি। তাই এখন আর্থিক নীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। জ্বালানিসহ আমদানিনির্ভর প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কহারও কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু ওই সময় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। পাঁচ বছর পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ৭ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এলেও মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। তার মানে ব্যাংক ঋণের সর্বনিম্ন সুদ সত্ত্বেও ওই বছর মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু গত অর্থবছর মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ সুদহার না বাড়লেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল।
এদিকে গত দুই অর্থবছর ধরেই দেশে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেয়া হয়। একই সঙ্গে দফায় দফায় বাড়ানো হয় নীতি সুদহার। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবছরের মধ্যেই ঋণের সুদহার ৯ থেকে বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশে ঠেকে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান হয়নি। এরই মধ্যে ২৫ আগস্ট থেকে আবারো নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নীতি সুদহার হবে ৯ শতাংশ। সম্প্রতি মুদ্রানীতি কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দেশে কেবল সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক এ মহাপরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিয়ে সরবরাহ চ্যানেলে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। সিন্ডিকেট করে কোনো গোষ্ঠী যেন পণ্যের দাম না বাড়াতে পারে, সেটা দেখতে হবে। ঋণখেলাপি বেশি থাকায় এবং দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে এখানে সুদহার সেভাবে কাজ করেনি। আর সময়মতো সুদহার না বাড়িয়ে অনেক দেরি করা হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি জটিল হয়ে পড়েছে। আর সুদহার বাড়ানো হলেও বিগত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছে। ফলে সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রা সরবরাহ সীমিত করার উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয়েছে।’
সম্প্রতি জুলাইয়ের ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ও মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাতে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে।
দেশে ২০১০-১১ অর্থবছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ। সে হিসাবে গত প্রায় ১৩ বছরের মধ্যে গত মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ঠেকে ১২ দশমিক ৩ শতাংশে। তারপর এই প্রথম আবার তা সাড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেল। যা গত দেড় দশকের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ।
শুধু আর্থিক নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। এর সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বনীতিতেও সমন্বয় আনা প্রয়োজন উল্লেখ করে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের শুল্ক ছাড় দিতে পারে সরকার। আমদানির ক্ষেত্রে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী একচেটিয়া প্রভাব ফেলে বাজারে। এসব মোকাবেলায় আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বাড়ানো প্রয়োজন। যদিও এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়।’