Originally posted in খবরের কাগজ on 1 June 2024
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকার নানাবিধ সমস্যায় রয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে অর্থসংকট দেখা দেবে। বিদেশি ঋণ নিলে পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাবের আশায় এডিপিতে বেশি পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পরিশোধের চাপ আরও অসহনীয় না হয়। ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিচক্ষণতার সঙ্গে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প সাজাতে হবে। যাতে ঋণের অর্থের ব্যবহার লাভজনক হয়, সময়মতো প্রকল্প শেষ হয়। এ ক্ষেত্রে সুশাসনের বিষয়ে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি তৎপর থাকতে হবে।
এদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে বেশ চাপে আছে অর্থনীতি। ঋণ মেটাতে গিয়ে অর্থসংকটে রয়েছে সরকার। পুরোনো দেনার বোঝা নামাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নতুন ঋণের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। এ কারণে আগামীতে আরও মাশুল গুনতে হতে পারে। একদিকে অতিমাত্রায় ঋণ নেওয়া, অন্যদিকে ডলারের বিনিময়ে টাকার ধারাবাহিক দরপতনের কারণে চাপের বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বের হওয়া যাচ্ছে না। এ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে ৬৭ শতাংশ বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে। ডলারের হিসাবে যা ৪৮ শতাংশ। এ সপ্তাহের শুরুতে ডলারের দাম আরেক দফা বেড়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই তলানিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
আগামী অর্থবছরের এডিপির আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ১ লাখ কোটি টাকা হিসাবে মোট এডিপিতে বিদেশি ঋণের প্রস্তাবিত পরিমাণ প্রায় ৩৮ শতাংশ। এ অর্থবছরের এডিপিতে এ উৎসের বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত এডিপিতে তা ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বরাদ্দ নির্ধারণের জন্য চার দিনের ধারাবাহিক বৈঠক হয়।
বৈঠকগুলোতে বিস্তারিত আলোচনার পরই প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দের প্রাথমিক খসড়া তৈরি হয়। গত তিন অর্থবছর এডিপিতে বিদেশি ঋণের বরাদ্দ প্রবণতায় দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ২০ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ৭৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা, সংশোধিত এডিপিতে কমিয়ে ধরা হয় ৭২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক অংশে বরাদ্দ ছিল ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ধরা হয় ৬৩ হাজার ১ কোটি টাকা।
বলা বাহুল্য, ডলারের মূল্য ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক অভিঘাত থাকবে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির উৎকর্ষে আরও বেশি নজর দিতে হবে। বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণে ঋণের সুদ আপাতত আরও বেড়ে যাবে। ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে, এটা ঠিক।
যদিও আগে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের দর ১১০ টাকা ছিল, তখন ব্যাংকগুলো থেকে ১১৭-১১৮ টাকায় কিনতে হয়েছে। এই দর সমন্বয় করতে ডলারের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এখন নতুন সিদ্ধান্তের পর তাৎক্ষণিকভাবে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১২৪-১২৫ টাকা উঠলেও তা আবার নেমে আসবে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে এটা ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না। দেশের প্রয়োজনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সিদ্ধান্ত অনেক আগে নেওয়া দরকার ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে আমানতের সুদ ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে রেখে ছিল। ডলারের দাম দীর্ঘদিন আটকে রাখায় সমন্বয় হয়নি। যার বিরূপ প্রভাব এখন পড়ছে। এই সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য অনেক নিচে থাকত। মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব এতটা পড়ত না। কম আয়ের মানুষের ওপর চাপ কম হতো।
এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি পণ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়াবে, যা ভোক্তাদের আরও চাপে ফেলবে। তবে যারা আগে থেকে ১১৭-১১৮ টাকা দরে আমদানি করেছে, সেখানে এখন মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা নয়। সরকার ১১০ টাকা ডলারে যেসব পণ্য এতদিন আমদানি করেছে, সেখানে ৭ টাকা বেড়ে যাওয়ার চাপ থাকবে, এটা সত্যি। তবে নতুন করে ডলারের দামে অস্থিরতা তৈরি না হয়, সেদিকে এখন নজর দিতে হবে। ডলারের নেতিবাচক প্রভাবে মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে আমাদের পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এখন থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া সুশাসন নিশ্চিত করে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনতে সরকারের বড় ভূমিকা নেওয়ার এখনই সময়।
মধ্য মেয়াদে মূল্যস্ফীতি কমাতে উৎপাদন বাড়াতে এবং বাজারে পণ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত নিশ্চিত করতে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক সহযোগিতা দিতে হবে। পণ্যের জোগান ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য এনে মনিটরিং জোরদার করলে বাজার সহনীয় পর্যায়ে আসবে। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির চাপ তৈরি হবে। এতে যেমন বিনিয়োগ কমবে; পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ জন্য ব্যবসার পরিচালন ব্যয় কমানো ও ব্যবসার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতা লাগবে। এটি করতে পারলে নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা প্রশমিত করা যাবে।
লেখক: বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো