Originally posted in কালের কন্ঠ on 10 January 2022
রপ্তানি বাণিজ্যে পণ্য বহুমুখীকরণ দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হলেও এ ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন নীতিতে (পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা), বার্ষিক কার্যক্রমে (রপ্তানি বর্ষ উদযাপন) বা রাজনৈতিক বক্তৃতায় রপ্তানিকে একমুখী পণ্য নির্ভরতা থেকে বের করে আনার লক্ষ্য ঘোষণার বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই লক্ষ্যে আমাদের অর্জন সামান্য। রপ্তানি বহুমুখীকরণে আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা কোথায়? সরকারের কোন উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, অথবা সরকারের কোন উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে? উদ্যোক্তাদের কোন দুর্বলতা এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
প্রথম বাধা সরকারের একমুখী নীতি কাঠামো। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত সরকারের সুবিধা কাঠামোর দুই-তৃতীয়াংশ পেয়ে থাকে। যুক্তি হিসেবে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলেন, যেহেতু এই খাত ৮০ শতাংশ (রপ্তানির চার-পঞ্চমাংশ) অবদান রাখে, সুতরাং বেশির ভাগ সুবিধা এই খাতের প্রাপ্য। অথচ বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিগত চার দশকের অভিজ্ঞতায় একটি প্রাপ্তবয়স্ক খাতে পরিণত হয়েছে। এ রকম একটি প্রাপ্তবয়স্ক খাতের জন্য সরকারের বেশির ভাগ সুবিধার তেমন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সাধারণত সরকারের বাণিজ্যসংক্রান্ত বা বিনিয়োগসংক্রান্ত সুবিধা দেওয়া হয় উদীয়মান খাতের জন্য—তাদের বিকাশের জন্য। প্রতিটি রাজস্ব বা আর্থিক প্রণোদনার উদ্দেশ্য থাকে, এসব সুবিধা নিয়ে রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খাত বিকাশ লাভ করবে। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সুবিধা তৈরি পোশাক খাতকে দেওয়ার ফলে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত, সরকারের বাড়তি রাজস্ব ব্যয়, যা থেকে এই খাতের তেমন কোনো উপকার হচ্ছে না। কেননা এই রাজস্ব ব্যয় না করলেও রপ্তানিতে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না। দ্বিতীয়ত, একটি খাতে বেশির ভাগ রাজস্ব ব্যয়ের ফলে অন্যান্য উদীয়মান খাতে পর্যাপ্ত রাজস্ব প্রণোদনার সুযোগ থাকে না। যতটুকু প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা খুব স্বল্পাকারে বিভিন্ন উদীয়মান খাতের Value chain-এ সামগ্রিক উন্নতির সহায়ক হয়। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের একমুখী নীতি সুবিধা ও সহযোগিতা কাঠামো ব্যবসায়ীদেরও একক খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে এবং উদীয়মান অন্যান্য খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহ করে। মোটকথা, রপ্তানি খাতে একমুখী কাঠামো থেকে বের হতে হলে সরকারের রাজস্ব ও আর্থিক প্রণোদনা ও সুবিধা কাঠামোর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ও পরিবর্তন দরকার।
রপ্তানি বহুমুখীকরণে উদ্যোক্তা বা বেসরকারি খাতের দুর্বলতাও চোখে পড়ার মতো। একটি নির্দিষ্ট খাত রপ্তানি বাজারে তখনই এগোতে পারে, যখন পণ্য ক্রেতারা (Buyer) পণ্যের অর্ডার দেওয়ার জন্য অনেক বিক্রেতার (Supplier) খোঁজ পায়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, বাংলাদেশের বেশির ভাগ উদীয়মান খাতই মাত্র এক বা একাধিক স্বল্পসংখ্যক বিক্রেতা উদ্যোক্তার ওপর নির্ভরশীল। একটি নির্দিষ্ট খাতের ন্যূনতমসংখ্যক বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার উপস্থিতি না থাকলে ক্রেতা অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত থাকে। বেশির ভাগ খাত কিছু বৃহৎ উদ্যোক্তা বা গ্রুপ অব কম্পানিজ নির্ভর হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খাতের বিকাশ শ্লথগতিতে হচ্ছে। এসব খাতে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক মানের পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও প্রদানের ক্ষমতা থাকা জরুরি। মোটকথা, প্রতিটি উদীয়মান খাতের Value chain-কে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাঁচামাল উৎপাদন বা আমদানি মধ্যবর্তী পণ্য উৎপাদন এবং পূর্ণাঙ্গ পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের সক্ষমতা অর্জন জরুরি।
উদীয়মান এসব খাতে স্বল্পতম সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা জরুরি। বাংলাদেশে প্রায়ই বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সব ধরনের সুবিধা রয়েছে এবং প্রায় সব খাত বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বাধার সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় বিনিয়োগ উৎসাহিত করার অজুহাতে বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহ করার একটা অলিখিত প্রবণতা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণে দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করা বিশেষভাবে জরুরি। মনে রাখা দরকার, বিদেশি উদ্যোক্তারা প্রথমে ক্ষুদ্র আকারের বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে বৃহদাকারের বিনিয়োগে যেতে চায়। সুতরাং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের বিদেশি বিনিয়োগ উদীয়মান খাতের জন্য উপযোগী এবং এর জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা দরকার।
পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বাজার বহুমুখীকরণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বহির্ভূত পণ্যের বড় বাজার অপ্রচলিত বাজারগুলোতে বিশেষভাবে বর্তমান। এসব বাজার মূলত ভারত, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বর্তমান। এর পাশাপাশি বাংলাদেশি অধ্যুষিত বা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর অবস্থানরত দেশগুলোতে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বাজার রয়েছে। অবশ্য এসব পণ্যের বাজার খুব বড় নয়। উপরোক্ত সব পণ্যের বাজারে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা খুব সীমিত আকারেই রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারছে ভিন্ন ভিন্ন কারণে। প্রথমত, অপ্রচলিত প্রায় প্রতিটি বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব দেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় পণ্য রপ্তানিতে উচ্চ শুল্ক এক বড় বাধা। যেমন—রাশিয়া, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় বাজারে ৩০-৪০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি সম্ভব নয়। রাশিয়ার মতো বাজারে সরাসরি এলসি খুলে রপ্তানির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ, যেমন—চীন বা ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ তা পর্যাপ্ত আকারে ব্যবহার করতে পারে না। যেমন—চীনের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনের শর্ত থাকায় তা মিটিয়ে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা খুব কমসংখ্যক পণ্যেই পাওয়া সম্ভব। ভারতের বাজারে অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপের কারণে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের অভ্যন্তরীণ স্ট্যান্ডার্ডের স্বীকৃতি ছাড়া অনেক পণ্য রপ্তানি সহজসাধ্য নয়। এ ক্ষেত্রে ভারত খুব অল্পসংখ্যক পণ্যেই এখন পর্যন্ত পারস্পরিক স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে স্যানিটারি ও ফাইটো স্যানিটারি স্ট্যান্ডার্ড পরিপালন গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই স্ট্যান্ডার্ড পরিপালনে সক্ষমতা অর্জন করেনি। ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডে পণ্য উৎপাদন জরুরি—সেসব দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য। এ ধরনের মানদণ্ড পরিপালন খুব অল্পসংখ্যক ল্যাব এবং সীমিতসংখ্যক পণ্যের জন্য ব্যাপক কারিগরি প্রস্তুতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জন সম্ভব। অন্যদিকে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানদণ্ড রয়েছে, যা পরিপালন দরকার হয় আমদানীকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে। যেমন—আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য আঞ্চলিক মানদণ্ড প্রবর্তন করেছে।
মোটকথা, তৈরি পোশাক বহির্ভূত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বাজারভিত্তিক, পণ্যমানভিত্তিক ও শুল্কবহির্ভূত বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করা বিশেষ প্রয়োজন।
লেখক : গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)