Published in সমকাল on Wednesday, 8 March 2017
উদ্যোগে কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বে নারী
এক দশক ধরে অর্থনীতিতে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দেশ ইতিমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের এ অগ্রযাত্রায় নারীর অবদান কম নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, উদ্যোগ আর কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। পাঁচ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদেও রয়েছেন নারী। মোট শ্রমশক্তিতে তাদের অংশগ্রহণ ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
৮৫ বছর আগে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, তখনকার সমাজে বাঙালি নারীর জগৎ ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই উপন্যাসে নারীরা সমাজের নেতৃত্বে থাকবেন সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন এখন বাস্তব রূপ পাচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছেন নারী। বড় বড় উদ্যোগও নিচ্ছেন অনেকে। এসব উদ্যোগ দেখে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করছে নারী উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক
বিশেষায়িত ঋণ। আবার নারীরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থেকে সুনামের সঙ্গেও কাজ করছেন। ব্যবসায়ী সংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বেও আসছেন নারীরা। ড্রাইভিং, বিপণন কর্মীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশাও বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
তবে নারীর পথচলায় এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কম মজুরির কাজে তাদের অংশগ্রহণ বেশি। উচ্চ মজুরির কাজে সুযোগ কম। আবার অনেক কর্মজীবী মা সন্তানের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু সেবা বা পরিচর্যা নিশ্চিত করতে না পেরে মাঝপথে চাকরি ছেড়ে ঘরে ফিরছেন। সময়ের সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তনের কারণে একক পরিবার বেড়ে যাওয়ায় অনেকের শিক্ষা, যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকলেও কাজ করার সুযোগ নিতে পারছেন না। করপোরেট ওয়ার্ল্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও শীর্ষ পদে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কম। যদিও কেউ কেউ সকল বাধা জয় করে যোগ্যতার স্বীকৃতি ছিনিয়ে নিচ্ছেন। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের সুব্যবস্থা নেই। গণপরিবহনই একমাত্র ভরসা। যৌন হয়রানির অভিযোগ তো রয়েছেই। আবার নারী উদ্যোক্তাদের উদ্যোগগুলোকেও সমাজের সকল পর্যায় থেকে ভালোভাবে দেখা হয় না। আছে অর্থায়নের সমস্যাও। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে আগ্রহ দেখায় না বলে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ওমেন চেম্বারের নেতারা অভিযোগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম সমকালকে বলেন, দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা সমানভাবে হচ্ছে না। বৈষম্য রয়েছে। নারীর অগ্রগতিতেও সেই বৈষম্য বিদ্যমান। তবে একথা সত্য নির্যাতন, শোষণ থাকলেও নারীর ক্ষমতায়ন অনেক হয়েছে। অনেক শোষণ ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে নারীরা ঘর থেকে বের হয়েছে। কাজ করছেন, উপার্জন করছেন। এতে ব্যক্তিত্ব বেড়েছে। স্বাধীনতা ভোগ করছেন। নির্যাতন, অত্যাচারের প্রতিবাদ করছেন। তবুও নারীরা এখনও পেছনে রয়েছে। পুরোপুরি আর্থিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা পাচ্ছেন না। এটা পেতে পুরুষের ভূমিকা আছে। মানসিকতার পরিবর্তন এনে পুরুষ আরও উদার হলে নারীর বিকাশ সহজ হবে। তিনি নারীকে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন সমকালকে বলেন, অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়ছে। দেশের অর্থনীতির প্রধান গতিময়তা আসছে তৈরি পোশাক শিল্প ও কৃষি খাত থেকে। এরমধ্যে তৈরি পোশাক খাতের মোট জনশক্তির ৮০ ভাগই নারী। এ খাতের মাধ্যমে মোট রফতানি আয়ের ৭৫ শতাংশ আসছে। ফলে রফতানি আয়ে নারীর বিশেষ অবদান রয়েছে। আবার কৃষিতে দেশ বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেখানেও নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। কৃষি খাতের বেশিরভাগ কাজই নারীরা করে থাকেন। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে বিশেষ করে আর্থিক খাতে, টেলিযোগ খাতে শিক্ষিত নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। গতানুগতিক খাতের বাইরে গাড়িচালক, বিক্রয় প্রতিনিধি, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং কাজেও নারীরা অংশ নিচ্ছে। কিন্তু যত আসা দরকার ততটা এখনও আসছে না। উচ্চ আয়ের খাতগুলোতে নারীকে আরও বেশি করে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। মায়ের কাজের সঙ্গে রাখতে মানসম্পন্ন শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ ও নিরাপদ করার প্রস্তাব করেন তিনি।
উদ্যোক্তা নারী :বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪১ হাজার ৬৭৫ জন নারী উদ্যোক্তা পাঁচ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকার এসএমই ঋণ নিয়েছেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই পরিমাণ ছিল চার হাজার ২২৭ কোটি টাকা। এসএমই ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। এতে সারাদেশের বিভিন্ন খাতে সাত হাজার ৬৪ জন নারী উদ্যোক্তার তথ্য রয়েছে। এসব নারী উদ্যোক্তা ফ্যাশন, ওষুধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্লাস্টিক, তৈরি পোশাক, চামড়া, ফার্নিচার, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল, সফটওয়্যার ও ইলেকট্রনিক্স খাতের। এসএমই ফাউন্ডেশন বলছে, নারী উদ্যোক্তারা শুধু পণ্য বা সেবা সরবরাহ করছেন তা নয়, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন। নারীর উৎপাদিত পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাজারে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমআরএর তথ্য মতে, দেশের ক্ষুদ্রঋণের তিন কোটি ৪৫ লাখ নারী গ্রাহক প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া দেশব্যাপী অনেক নারী ছোট ছোট দোকান পরিচালনা করে সংসার চালাচ্ছেন।
নেতৃত্বে নারী :আর্থিক খাতের নেতৃত্বের বেলায়ও নারীরা অনেক এগিয়েছে। দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী সংগঠন এমসিসিআইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারী। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন এফআইসিসির নেতৃত্বে রয়েছেন নারী। যিনি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বেও রয়েছেন একজন নারী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ পদে নারীরা কাজ করছেন। কয়েকটি ব্যাংকের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক বা এসভিপির মতো পদে নারীরা কাজ করছেন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রধানও একজন নারী।
কর্মক্ষেত্রে নারী :বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি-২০১৩-এর তথ্য অনুযায়ী, অর্থনীতিতে সক্রিয় নাগরিকের সংখ্যা ৬ কোটি ৭ লাখ। এর মধ্যে এক কোটি ৮২ লাখ নারী। বিবিএসের জরিপের তথ্য মতে, দেশের ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ নারী শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭৪ সালে এই হার ছিল মাত্র চার শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতের ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ বা প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নারীরা কাজ করছেন। শীর্ষ পদ বলতে প্রধান নির্বাহী বা নীতিনির্ধারণী উচ্চপদগুলোকে বোঝানো হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত তিন বছরে এ অবস্থান আরও বেড়েছে। দেশে কার্যরত ৯৬টি কলসেন্টারে প্রায় ৩০ হাজার কর্মী কাজ করছেন, যাদের ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ১২ হাজার নারী কর্মী। এসব নারী কর্মী দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গ্রাহকদের যেমন সেবা দিচ্ছেন, তেমনি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেবা দিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে অবদান রাখছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটি ওই বছর ড্রাইভিং, হোটেল ও রেস্তোরাঁর কর্মী, ইলেকট্রনিক ও ইকেট্রিক্যাল মেকানিক, প্লাস্টিক খাতে পাঁচ হাজার ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের ৫৭ শতাংশ নারী। যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট খাতে কাজে নিযুক্ত হয়েছেন।
২০১৫ সালে মাস্টার কার্ডের এক জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর কর্মসংস্থানে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তান বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে। শুধু নেপাল এগিয়ে রয়েছে। আর দেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের সিংহভাগ নারী। এ ছাড়া রফতানি আয়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য খাত হিমায়িত মৎস্য, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধশিল্পেও প্রচুর নারী কাজ করছেন। অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি খাতের উল্লেখযোগ্য কাজ নারীদের মাধ্যমে হচ্ছে। বিবিএস বলছে, নারী শ্রমিকের অধিকাংশ কাজ করছে এ খাতগুলোতে।
প্রবাসে নারী :প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ লাখ ৯৩ হাজার নারী কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। প্রতি বছরই দেশ থেকে অনেক নারী-পুরুষ বিদেশে কাজের জন্য যান। আবার ফিরেও আসেন অনেক। ফলে বিদেশে কতজন নারী শ্রমিক অবস্থান করছেন তার তথ্য নেই বিএমইটির কাছে। তবে গত বছর সবচেয়ে বেশি এক লাখ ১৮ হাজার নারী বিদেশে গেছেন। এসব নারীর মাধ্যমে কী পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি সঞ্চয়ী হওয়ায় তাদের উপার্জিত অর্থের সিংহভাগই দেশে পাঠান।
ই-কমার্সে নারী :নতুন ধারার ব্যবসা ই-কমার্সেও নারীরা এগিয়ে এসেছেন। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য মতে, সংগঠনটির নিবন্ধিত সদস্যের ১০ শতাংশ নারী। তবে অনিবন্ধিত অনেক নারী ই-কমার্স করছেন। ই-ক্যাবের সভাপতি রাজীব আহমেদ সমকালকে বলেন, ই-ক্যাবের ৫৯০ সদস্যের মধ্যে ৬০ জন নারী উদ্যোক্তা। তবে অনেক নারী ঘরে বসে ফেসবুক পেজ খুলে ব্যবসা করছেন। কিন্তু তারা ই-ক্যাবের সদস্য নন। তিনি বলেন, ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন ও ভ্যাট নিবন্ধনে নারীর কিছু জটিলতা বা জড়তা থাকায় তারা ই-ক্যাবের সদস্য হতে পারেননি। তবে ই-কমার্সে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।