Originally posted in সমকাল on 6 October 2023
অনেক বছর ধরেই আমরা ‘বিজয়ী সব সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করবে’– এ সংস্কৃতি থেকে রাজনীতিকে বের করে আনার পথ খুঁজছি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যে, রাজনীতির খেলায় হেরে যাওয়া মানেই জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়া নয়।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান (জন্ম ১২ মার্চ ১৯৩৫) বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, চিন্তক। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ও ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান চেয়ারম্যান। রেহমান সোবহানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব আজীজ
গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত বা ভিত্তি বহুমতের সহাবস্থান। আমাদের রাজনীতিতে বহুমতের চর্চা কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে? আমাদের গণতন্ত্র বা রাজনীতিতে বহুমতের চর্চার সংকট কী কী?
রেহমান সোবহান: আমাদের রাজনীতিতে এখন বহুমত চর্চার খুব অল্পই অবশিষ্ট আছে। ‘বিজয়ী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করবে’– এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতায় যাওয়া এবং তারপর যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা হয়ে পড়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ একবার যদি ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে ক্ষমতাসীনদের জীবন-জীবিকা সবই খোয়া যাওয়ার ভয় থাকে। এমন রাজনৈতিক পরিবেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন।
নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো কী?
বাংলাদেশে যখন নির্বাচন একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় তখন নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দলীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমরা দেখেছি একটার পর একটা সরকার রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে নির্বাচন তদারকির দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করা খুবই কঠিন। যেহেতু ইসি একটি দলীয় সরকার দ্বারা মনোনীত ও পরিচালিত হয়, তাই ইসির পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা দুরূহ।
একসময় যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিল, এখন তারা এর বিরোধী। যেখানে দুটি পক্ষের একে অন্যের প্রতি চরম অবিশ্বাস রয়েছে, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অনেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যম মনে করছেন। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য আশা করছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তখন ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অত্যন্ত জোরালো হয়ে উঠেছিল, কারণ প্রধান বিরোধী দলসহ প্রায় সব বিরোধী দলেরই বিশ্বাস ছিল যে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়; কেননা যখন যে দল ক্ষমতায় থাকবে তারাই যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর হবে। ইতিহাস বলছে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৯০, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কোনো শাসক দলের অধীনে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। পরিস্থিতি শাসকদের অবাধ নির্বাচন আয়োজনে বাধ্য করে। তবে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে শুধু ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮– এই চার সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে চারবারই তৎকালীন বিরোধী দল জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়।
আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী বক্তব্য দিচ্ছেন। এটি কি আমাদের গণতন্ত্রের দুর্বলতাকে নির্দেশ করে?
যখন বিদেশি কূটনীতিকরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলার তাগিদ অনুভব করতে থাকেন তখন আমাদের রাজনীতির দীনতাই প্রকাশ করে। দেশে একটি কার্যকর গণতন্ত্র থাকলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকে না। তখন যদি তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলতেন– শুধু সরকার কেন, বিরোধী দলসহ সুশীল সমাজেরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তেন।
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। এটি কি গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত?
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারই আমাদের একাত্তরের গণহত্যার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। রাজনীতিতে এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক খেলা। ’৭২-এর সংবিধান প্রণেতারা একে বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন। তবু রাজনৈতিক দলগুলোকে এর রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য তা যথেষ্ট নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি রাজনৈতিক সমর্থন বাড়াতে ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার করে ভোটের রাজনীতিতে তাদের বিজয় নিশ্চিত করেছে।
আমাদের অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কি তা কমিয়ে দিতে পারে?
আমাদের উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসিত হয়েছে। তবে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে পারে। এই অস্থিতিশীলতা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বকে দুর্বল করবে।
আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান নিচের দিকে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে?
উচ্চ মূল্যস্ফীতি জনসাধারণের ব্যাপক ক্ষতি করে, বিশেষ করে জনগণের দরিদ্র অংশের। এই মূল্যস্ফীতি জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে, যেটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা শেষ পর্যন্ত শুধু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই নয়; বরং যে কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
অনেকের মতে, টেকসই গণতন্ত্র ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
টেকসই গণতন্ত্র ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশসহ বেশির ভাগ দেশের জন্য এ কথা প্রযোজ্য। তবে চীন, ভিয়েতনাম এমনকি সিঙ্গাপুরের মতো দেশের সাফল্যের গল্পগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে এটি সর্বজনীন সত্য নয়।
আমাদের গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে বহুমতের চর্চার যে সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
অনেক বছর ধরেই আমরা ‘বিজয়ী সব সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করবে’– এ সংস্কৃতি থেকে রাজনীতিকে বের করে আনার পথ খুঁজছি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যে রাজনীতির খেলায় হেরে যাওয়া মানেই জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়া নয়। রাজনীতিকদের এই আশঙ্কা দূর করা ছাড়া বহুমত সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দুই দলেরই বড় দায় রয়েছে।