Rounaq Jahan draws on the regressive trend in Bangladesh Politics, published in Prothom Alo on Thursday, 6 November 2014.
রাজনৈতিক দল: তখন ও এখন
রওনক জাহান
১৯৬০-এর দশকের শেষ ভাগে যখন নিজের পিএইচডি থিসিসের গবেষণার জন্য আমি রাজনীতিকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, সে সময় বাঙালি ও পাকিস্তানি রাজনীতিকদের মধ্যে একটি ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করেছিলাম। যেসব পাকিস্তানি রাজনীতিকের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি, তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন সম্পদশালী। তাঁদের বাসভবন ছিল বেশ বড়, ব্যক্তিগত গাড়িও ছিল তাঁদের। আর আমি সাক্ষাৎকার শুরু করার পরপরই বেয়ারা একটি ছোট ট্রলিতে চা ও হরেক রকম নাশতা নিয়ে আসত। অন্যদিকে বাঙালি নেতারা থাকতেন খুবই সাধারণ বাড়িতে, তাঁদের কোনো গাড়ি ছিল না, সোফা ছিল না আর কোনো বেয়ারাও ট্রলিতে চা ও নাশতা নিয়ে আসত না।
৪০ বছর পর ২০১০-১২ সালে আমি যখন আবার সংসদ ও রাজনৈতিক দলের ওপর গবেষণা শুরু করি, তখন আমি আবার বাঙালি রাজনীতিকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করি। এ সময় আমি দেখলাম, বাঙালি রাজনীতিকদের বৈষয়িক ভাগ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গত কয়েক বছরে যে রাজনীতিকদের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি, তাঁরা সবাই বনানী ও গুলশান এলাকার বড় বড় বাড়িতে বাস করেন, তাঁদের সবারই গাড়ি আছে; আর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় চা ও নানা রকম নাশতা দিয়ে আমাকে আপ্যায়ন করা হয়েছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে বলতে হয়, বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের এই সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তাঁদের ভাবমূর্তি তেমন উজ্জ্বল হয়নি। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ইতিবাচক ভূমিকার কথা আমরা স্মরণ করেছি, এমনকি ১৯৮০-এর দশকেও গণতন্ত্রের আন্দোলনে তাঁদের উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার হওয়ার পর তাঁদের ভাবমূর্তি ক্রমাগত নিম্নগামী হতে শুরু করে। রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি ও অপরাধমূলক তৎপরতায় সংশ্লিষ্টতার খবর হরহামেশাই আমরা খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পারি।
মনে হয়, তাঁরা বস্তুত আইনের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, রাজনীতির দুর্নীতিকরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রহীনতার কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংহত হচ্ছে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক ভূমিকার অবক্ষয়
১৯৯১ সালে নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন হওয়ার পর মূল ধারার দলগুলো সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের সমর্থক সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। এর ফলে তাদের আদর্শিক ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়, নীতিও দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণামে, দলগুলো জনগণের প্রত্যাশামাফিক কাজ যেমন, বিভিন্ন দুর্বল জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ, নেতাদের প্রশিক্ষণ, নীতি প্রণয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সংহতকরণ—এসব বিষয়ে কিছু করতে অনীহ হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমাগত পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, আদর্শ বা নীতি দূরবর্তী ব্যাপারে পরিণত হয়। মানুষের সম্পদ লাভের যে প্রতিযোগিতায় তারা নামে, তার ফলে ব্যাপক দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। দলের ভেতরেও এসব লুটপাটের ভাগের কারণে নানা রকম উপদল গড়ে ওঠে। ফলে দলের ভেতরে শৃঙ্খলা ক্ষয়ে যায়। উপদলীয় কোন্দল ও নেতাদের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটে, নানা রকম চক্রও গড়ে ওঠে। দলের সর্বোচ্চ নেতাই শুধু এসব কোন্দল মেটানোর ক্ষমতা রাখেন। অন্যদিকে এক ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীলতা, অর্থাৎ বিধানের চেয়ে নেতার ওপর নির্ভরশীলতার কারণে এসব উপদলীয় কোন্দল মেটানোর অন্যান্য গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
বছরের পর বছর ধরে দলগুলোর ভেতরে ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক ধারা লক্ষ করা গেছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, দল পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। দলের কাউন্সিলে বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচিত না হয়ে মনোনয়ন প্রথা শুরু হয়। দলের গঠনতন্ত্রে তৃণমূলের হাতে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা থাকলেও বস্তুত তাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। দলের আদর্শিক ও নীতিগত বিষয়ে খুব সামান্যই তর্ক-বিতর্ক হয়। মূল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সাধারণত দলের প্রধান নেতাই নিয়ে থাকেন। দলের প্রচারকাজ ও তহবিলের উৎস সাধারণত অস্বচ্ছ।
দলগুলো ক্রমাগতভাবে ধনী ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে; এই ব্যক্তিরা বস্তুগত স্বার্থে দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। তাঁরা দলের তৎপরতায় যুক্ত হন একটি ব্যবসায়ী বিনিয়োগের মনোভাব নিয়ে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বে একদল ক্ষমতাধর মানুষ আসীন হয়েছেন, যাঁরা সহিংসতার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের স্বার্থে তা ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তাঁরা প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখেন। এ কারণে দলগুলোর মধ্যে আন্তদলীয় ও অন্তর্দলীয় কোন্দল বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে গণতন্ত্রই হুমকির মুখে পড়ে গেছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সংঘাতের চেয়ে উপদলীয় কোন্দলের কারণেই বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। আর ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই এসব উপদলীয় কোন্দল বেশি দেখা যায়।
প্রস্তাবিত ব্যবস্থা
বাংলাদেশে এ বিশ্বাস ক্রমেই জোরালো হচ্ছে যে রাজনৈতিক দলগুলো দেশে গণতন্ত্র প্রবর্তনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলে বা দলের ভেতরে গণতন্ত্রচর্চার চেষ্টা করলেই শুধু গণতন্ত্র টেকসই হতে পারে। দেশে গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে:
প্রথমত, নিজেদের সমর্থকদের সুবিধা দেওয়া ও প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। গণতন্ত্রের একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে আইনের শাসন। রাজনৈতিক দলগুলো যদি দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রের ব্যবহার বন্ধ না করে, তাহলে আইনের শাসন কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না।
দ্বিতীয়ত, উপদলীয় ও আন্তদলীয় কোন্দল নিরসনে সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। এক দলের সঙ্গে অন্য দলের, একই দলের ভেতরে বিভিন্ন উপদলের এবং দলগুলোর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতের কারণে দ্বন্দ্ব নিরসনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, বিরোধী দলে থাকার সময় দলগুলোর সংসদ বর্জনের রীতি বর্জন করতে হবে। সরকারের জবাবদিহির জন্য সংসদকেই কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
চতুর্থত, রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থকদের সুবিধা বিতরণের জায়গা থেকে সরে এসে বিধান ও নীতিভিত্তিক সংগঠনে পরিণত হতে হবে। দলগুলো পৃষ্ঠপোষক-সুবিধভোগী নেটওয়ার্ক বিস্তারে ব্যস্ত থাকায় গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তারা নানা কারণেই দুর্নীতি ও অপরাধমূলক তৎপরতার ওপর নির্ভরশীল।
পঞ্চমত, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সরকার ও দলের মধ্যে একটি পার্থক্যরেখা টানা। দলের নেতারা, যেমন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য পদধারী ব্যক্তিরা পুরো সময় দলের জন্যই ব্যয় করবেন, কোনো সরকারি দায়িত্ব যেমন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী প্রভৃতি পদে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া চলবে না। এই পৃথক্করণ সম্ভব হলে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করা সম্ভব হবে, সব উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রেই তারা এ কাজটি করে থাকে। ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রধান কাজ সরকারের নীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, এসবের সমালোচনা করা ও জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সরকারের সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করাই ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র কাজ নয়।
সবশেষে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ হবে সমাজের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর স্বার্থ প্রতিফলিত ও তা ব্যক্ত করা এবং যথাযথ নীতি প্রণয়ন করে সেটা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া। রাজনৈতিক দলগুলো এখন ক্রমাগত ব্যবসায়ী মহলের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, ফলে সরকারের নীতিতে অন্যান্য সামাজিক মহলের বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ প্রতিফলিত হচ্ছে না। যদিও এই মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা জোরদার করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত অগ্রাধিকারভিত্তিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দলগুলোর নিজস্ব গঠনতন্ত্র ও গণপ্রতিনিধিত্ব বিধিমালা (আরপিও) অনুসরণ করা উচিত। আরও সুনির্দিষ্ট হয় যদি বলি, সব স্তরের নেতৃত্ব গোপন ব্যালটে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে নিয়মিত নির্বাচনের প্রথা অনুসরণ করতে হবে। তৃণমূল সংগঠন যে প্যানেল নির্বাচন করবে সেখান থেকে বাছাই করে প্রার্থী মনোনীত করতে হবে। এর পাশাপাশি দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় ক্রমেই নারী, সংখ্যালঘু ও নিম্ন আয়ের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করতে হবে। বিভিন্ন স্তরে দলের আদর্শিক ও নীতিগত বিতর্কের মাধ্যমে দলের ফোরাম আরও শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমানে দলের কর্মীদের কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তর্ক-বিতর্কের সুযোগ নেই। ওপর থেকে নেতারা যে আদেশ দেন, তাঁরা শুধু সেটা অনুসরণ করেন। তাঁদের সময় কাটে বিভিন্ন ‘দিবস’ পালনের কর্মসূচির মাধ্যমে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি দলের কর্মসূচি ও তহবিলের টাকা সংগ্রহে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তাতে দলগুলো ক্রমেই বিশেষ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, দুর্নীতি ও অপরাধমূলক তৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। এটা প্রতিরোধ করতে হলে রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে দলগুলোর অর্থ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, তা সেটা নির্বাচনের জন্যই হোক বা সাংগঠনিক কাজের জন্যই হোক। ইউরোপের কিছু দেশে এই ব্যবস্থা আছে। অবশ্যই সরকারি তহবিল থেকে দলগুলোকে যে অর্থ দেওয়া হবে তা পেশাদারির সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এসব তহবিলের স্বাধীন অডিট হতে হবে, সংসদে তা পেশ করতে হবে এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। তদুপরি দলের নির্বাচনী প্রচারণা ও দলীয় তহবিলের যে সীমা আরপিওতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের উচিত তা যথাযথভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না, সেটার তদারকি করা। প্রচারণা ও তহবিলের অর্থের অব্যবস্থাপনা হলে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা তদন্ত করতে হবে। আর এসব আইন ভঙ্গ করা হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
রওনক জাহান: সম্মানিত ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।