রাজনৈতিক পচন অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে – ড. ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in কালবেলা on 23 October 2024

ড. ফাহমিদা খাতুন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক। ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, অর্থনীতির সংস্কার, রাজনীতি-অর্থনীতিসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। এই গণঅভ্যুত্থানের কারণ কী বলে মনে করেন?

ফাহমিদা খাতুন: বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক কারণে ঘটেনি। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এ গণঅভ্যুত্থানের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। গত দেড় দশকে বা স্বাধীনতা-উত্তর ৫০ বছরে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তা দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য দেশের অর্থনীতিতেও পচন ধরেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে, প্রবৃদ্ধিও হয়েছে তবে এতে শুধু একটি শ্রেণি উপকৃত হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ সেই অর্থনৈতিক উন্নতির বা সামাজিক অগ্রগতির সুফলগুলো পায়নি।

গত ৫০ বছরের অর্থনীতিতে আমরা দেখেছি, একদিকে অগ্রগতি অন্যদিকে বৈষম্য। একদিকে আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলছি, অন্যদিকে অসহনীয় বেকারত্ব। ফলে আমরা যে অর্থনৈতিক উন্নয়নটা দেখেছি, তা ছিল সম্পূর্ণরূপে ভারসাম্যবিহীন। আর এটা আমাদের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের একটি প্রতিফলন। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে পচন ধরেছে, সেই পচন আমরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও প্রচণ্ডভাবে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

দেশে এখন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন বা রাষ্ট্র সংস্কারের জোর দাবি উঠছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে একটি অন্যতম দাবি রাষ্ট্র সংস্কার এবং এর মাধ্যমে একটি বৈষম্যবিহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ দাবির কারণ বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা বঞ্চনা। আমরা যতই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগান গাই না কেন, সেই প্রবৃদ্ধির সুফল মানুষের কাছে পৌঁছেনি। আমরা আসলে কখনোই একটি বৈষম্যবিহীন সমাজ পাইনি। বিগত দশকে আমাদের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তাতে সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে কিন্তু অন্যদিকে বৈষম্যও বাড়ছে। ওপরের ৫ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৩০ শতাংশের বেশি সম্পদ। আর নিচের ৫ শতাংশ মানুষের হাতে মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ০.৩৭ শতাংশ সম্পদ। প্রতি বছর এই বৈষম্য আরও বাড়ছে। এই যে সমাজ ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি, যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো প্রতিফলন দেখতে পাইনি। ফলে ছাত্ররা প্রথমে রাস্তায় নেমে এসেছে এবং সেই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে সাধারণ মানুষ। গত দুই-তিন বছর ধরে, অধিক মূল্যস্ফীতি কিন্তু মানুষের আয় না বাড়া মানুষকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে।

মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বিগত সরকার। অন্যদিকে একটি শ্রেণি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করেছে। তাদের থামানোর জন্যও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মানুষ সবকিছু দেখেছে এবং তাদের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে। সবমিলে এ আন্দোলনটি ছাত্রদের মাধ্যমে শুরু হলেও তা ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই আন্দোলন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। মানুষ সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি চাচ্ছিল।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কী কী সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছেন?

ফাহমিদা খাতুন: অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই সংস্কার প্রয়োজন। বিগত দশকগুলোতে আমাদের অর্থনীতিতে যে উন্নয়ন বা অগ্রগতি এসেছে, তা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। যখন কোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয় সেখানে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন হয়। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে আসে, সেবা এবং শিল্প খাতের অবদান বাড়ে। বাংলাদেশেও আমরা সেই ধারাবাহিকতা দেখতে পেয়েছি। আমাদের জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ৫০ শতাংশের ওপরে। শিল্প ক্ষেত্রে অবদান ৪০ শতাংশের কাছাকাছি এবং কৃষি খাতের অবদান ১০ শতাংশের মতো। একসময় আমাদের জিডিপির ৮০ শতাংশই আসত কৃষি খাত থেকে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সেখানে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটেনি। আমাদের সামনে যে সম্ভাবনা ছিল, তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের শিল্প খাত আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। আমাদের একটি বড় ব্যর্থতা, জিডিপিতে কৃষির অবদান কমেছে কিন্তু মোট জনশক্তির একটি বড় অংশই কৃষি খাতে নিযুক্ত রয়েছে। এর অর্থ হলো, অনেকেই এখানে রয়েছেন যারা অর্ধ বেকার বা মৌসুমির বেকার। এজন্য প্রতিটি খাত ধরে ধরে সংস্কার প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিটি খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চিন্তা করতে হবে। একদিকে আমাদের দরকার দক্ষ মানবসম্পদ, পাশাপাশি দরকার উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নতুন ইনোভেশনের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের বার্ষিক বাজেটে ইনোভেশনে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না।

আমাদের অর্থনীতিতে কোনো বৈচিত্র্য আসছে না। নির্দিষ্ট কয়েকটা খাতের ওপরই দাঁড়িয়ে আছি আমরা। রপ্তানির ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকই আমাদের সবকিছু। এর বাইরে পণ্যের বহুমুখীকরণ ঘটছে না। নতুন কোনো শিল্প গড়ে উঠছে না। তৈরি পোশাক রপ্তানি কোনো কারণে কমে গেলে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। আমাদের এই বিশাল জনশক্তিকে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। সবার জন্য নিরাপদ জীবিকার বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই আমাদের জরুরিভাবে অর্থনীতির বহুমুখীকরণ চিন্তার কোনো বিকল্প নেই।

কোথায় দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন?

ফাহমিদা খাতুন: আমাদের অর্থনীতি একটি উদীয়মান অর্থনীতি এবং সামনে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন শক্তিশালী অবকাঠামো। একই সঙ্গে ভৌত এবং সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন বাড়াতে হবে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় আমাদের কর জিডিপির রেশিও অনেক কম। তাই এখানে একটি বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন। সংস্কারের প্রয়োজন সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রগুলোতেও। কারণ গত ১৫ বছরে আমরা এমন অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প দেখেছি যেগুলো আদতে কোনো কাজে আসেনি। এসব প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করার ব্যবস্থা বা ইচ্ছা কোনোটাই বিগত সরকারের ছিল না। এসব প্রকল্পে ব্যয়ের কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। শুধু নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে খুশি করতে এবং লুটপাট করতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়।

আমাদের সংস্কারটা এমন হতে হবে যে, কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, মানুষের কতটুকু প্রয়োজনে আসবে, তা যাচাই করা এবং প্রতিটি প্রকল্পে ক্ষেত্রবিশেষে জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ থাকা।

একটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করার আরেকটি অন্যতম উৎস হলো বৈদেশিক বিনিয়োগ। বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশে টেকসই কর্মসংস্থান বাড়াতে সহযোগিতা করে। আমাদের অর্থনীতিকে আমরা উদীয়মান অর্থনীতি বলছি, অথচ আমাদের জিডিপিতে এফডিআইয়ের অবদান ১ শতাংশের নিচে। এত কম বৈদেশিক বিনিয়োগ দিয়ে কোনো দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যেতে পারে না। ফলে একদিকে যেমন আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, অন্যদিকে প্রয়োজন সংস্কারের। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে। কাগজে-কলমে অনেক ভালো ভালো কথা লেখা আছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের অনুকূল পরিবেশ নেই। এ কারণেই বিদেশিরা বাংলাদেশের বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না।

আমাদের দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক বেশি। সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতির দৌরাত্ম্য ও মসৃণ অবকাঠামোর অভাব। জ্বালানি ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের সংকট, পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রযুক্তির অভাব। এসব কারণে আমাদের দেশে এখনো আশানুরূপ বৈদেশিক বিনিয়োগ হচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

সংস্কার প্রয়োজন আমাদের আর্থিক খাতে। ব্যাংক খাত, নন-ব্যাংকিং প্রাইভেট খাত এবং পুঁজিবাজার প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে চরম লুটতরাজ হয়েছে, যার কারণে ব্যাংকের ওপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে গেছে। একই সঙ্গে ব্যাংক থেকে লুটপাট করা এসব অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে একটি সীমাহীন সংকটের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

আর্থিক খাতের বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?

ফাহমিদা খাতুন: ভালো আইন থাকা একটি বিষয় আর ভালো আইন থাকার পাশাপাশি তার প্রয়োগ করা আরেকটি বিষয়। আমাদের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে তা হলো, ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিকভাবে দখল করা হয়েছে। ফলে আইন থাকার পরও সেসব আইনের কোনো কার্যকারিতা ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে দলীয় ব্যক্তিদের। অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করে সেগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে দলীয় লোকজনের হাতে। এরপর ঋণ দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং রাজনৈতিক সুপারিশে। ফলে বড় বড় সব ঋণখেলাপি হয়েছে। ব্যবসা, পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎসহ প্রতিটি খাতে এই একই ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে দেশের আর্থিক খাত গুটিকতক ব্যক্তির হাতে জিম্মি হয়ে গেছে এবং তারা দেশের অর্থনীতিতে ধ্বংস করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবজনিত কারণে তারা কখনোই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। একইভাবে রাজনৈতিকভাবে আনুগত্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ায় তারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি বরং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বার্থ উদ্ধারে তাবেদারি করে গেছেন।

পরিসংখ্যানের মান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?

ফাহমিদা খাতুন: আমাদের দেশের অর্থনৈতিক তথ্য বিভ্রাট নিয়ে আমরা বহু বছর ধরে কথা বলে আসছি। অর্থনীতিবিদরা যখন কোনো কিছু বিশ্লেষণ করেন এবং তার ভিত্তিতে কোনো সুপারিশ দেন, সেখানে সঠিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত এক দশকে অর্থনৈতিক খাতে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন তথ্য সঠিক ছিল না সেটা আমরা সবসময় বলে এসেছি। কারণ একজন অর্থনীতিবিদ তথ্য দেখলেই সহজে বুঝতে পারেন সেটা সঠিক নাকি তাতে গোঁজামিল রয়েছে। সরকার বিরাট অঙ্কের প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, আমরা সেটা দেখেই প্রশ্ন করেছি, এত প্রবৃদ্ধি কোথা থেকে হচ্ছে? আমরা প্রশ্ন করেছি যদি প্রবৃদ্ধি এ পরিমাণ হয়েই থাকে তাহলে তার প্রভাব অন্য জায়গায় পড়ছে না কেন? আমরা বারবার অনুরোধ করে এসেছিলাম যাতে জনগণকে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়। তথ্য সঠিক হলে নীতিনির্ধারকদেরও নীতি প্রণয়নে সুবিধা হয়। ভ্রান্ত তথ্যের ওপর ভ্রান্ত নীতিমালা হবে।

আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছি, সেখানে যে তিনটি শর্ত বা সূচক রয়েছে সবই বাংলাদেশ পূর্ণ করতে পেরেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে। এর আগে ২০২৪ সালেই বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েট করার কথা ছিল কিন্তু সে সময় কভিড আসায় বিভিন্ন সূচকে আমরা পিছিয়ে গিয়েছিলাম। এ কারণেই দুই বছর পর এটা হতে যাচ্ছে।

তবে আমার কাছে মনে হয়, যদি আমরা সঠিক তথ্য এবং প্রকৃতপক্ষেই সূচকগুলোতে আমাদের অবস্থান কী, সেটা যদি বের করি তাহলে হয়তো হিসাবটা অন্যরকম হতে পারে। যদি দেখা যায় সত্যিকার অর্থে সূচকগুলোতে আমাদের অতটা উন্নতি হয়নি তাহলে আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের ক্ষেত্রে আরও দুই বছর সময় বাড়াতে পারি। কারণ যে মুহূর্তে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হব তখনই আমরা অনেক সুযোগ হারাব। এটা সত্যি যে, এলডিসি উত্তরণ একটি ইমেজের বিষয় কিন্তু নিজেদের সংকটের মধ্যে রেখে ইমেজ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমরা উন্নয়নশীল দেশ হওয়া নিয়ে অনেক উৎসাহিত। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হলে আমরা যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ব, তা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি আমাদের নেই। আমরা শুল্কমুক্ত বাজার ব্যবস্থার সুবিধা হারাব, যা আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল কর্মসংস্থানহীন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

ফাহমিদা খাতুন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে অনেক সুযোগ রয়েছে। সরকারে যারা রয়েছেন তারা কেউই কোনো দলীয় ব্যাগেজ নিয়ে আসেননি। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক অভিজ্ঞ। ছাত্ররা যেসব দাবিদাওয়া করে আসছে এবং আমরা যেসব কথা বলছি, সরকারের যারা রয়েছেন তারা সবাই এসব দাবি এবং কথার সঙ্গে একমত। সুতরাং কর্মসংস্থানের যে দাবি শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, তা পূরণ করতে না পারলে সেটা হবে বড় ব্যর্থতা। আমরা প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অন্যান্য অনেক দিক থেকে দরিদ্র হতে পারি কিন্তু আমাদের রয়েছে বিশাল জনশক্তি। এ জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে না পারলে আমরা পিছিয়ে থাকব।

এ বিশাল জনশক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ আমাদের রয়েছে। আমরা এটাকে বলি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। আমাদের শ্রমবাজারে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে। এই ২০ লাখের সবার জন্য অফিসে কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা যাবে না। কারণ আমাদের অর্থনীতির আকার এখনো এতটা বড় হয়নি। তাই কাউকে কাউকে অফিসে চাকরি করার চিন্তার বাইরে উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা করতে হবে। আমাদের একটি উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা একই সঙ্গে নিজের কাজের ক্ষেত্রে তৈরি করেন এবং পাশাপাশি আরও অনেকের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করেন। তাই বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সহজ শর্তে মূলধন সরবরাহ করতে হবে। আমাদের তরুণদের বোঝাতে হবে যে, চাকরির থেকে উদ্যোক্তা হওয়াটা অনেক বেশি সম্মানের। এ জায়গাটায় যদি আমরা ভালো করতে পারি তাহলে দেশের অর্থনীতি যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ।

আমরা দেখেছি, আমাদের ব্যাংকগুলোতে লাখ লাখ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়েছে। একেকজন ব্যক্তি কত হাজার কোটি টাকা একাই আত্মসাৎ করেছেন। অথচ এরকম একজনের খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ টাকা যদি শিক্ষার্থীদের দিয়ে তাদের উদ্যোক্তা হতে সহযোগিতা করা হতো, তাহলে কত হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হতো! কর্মসংস্থান হতো লাখো মানুষের। তাই আমাদের সে রকমই একটি পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে শিক্ষিত তরুণরা স্বাবলম্বী হতে পারে।

আমাদের অনেক ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। এসব ট্রেনিং সেন্টারে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, এমনকি বিগত সরকারের আমলেও হয়েছে। কিন্তু এসব ট্রেনিং সেন্টারের প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ট্রেনিংয়ের গুণগত মান আমাদের শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মেলে না। তাই এখানেও সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

সরকারের অর্থনৈতিক প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর উপায় কী?

ফাহমিদা খাতুন: সরকারি প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি সমস্যা দেখা যায়। একটি হলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, অন্যটি মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়। দুভাবে ব্যয় বাড়ানো হয়। প্রথমত প্রকল্পে অত্যধিক খরচ ধরে এবং দ্বিতীয়ত প্রকল্প দীর্ঘায়িত করে। অতিরিক্ত খরচ করার কারণে প্রকল্প কস্ট ইফেকটিভ হয় না। আর এ সমগ্র ভারটি পড়ে জনগণের কাঁধে।

প্রকল্প পরিচালক কিংবা জনপ্রশাসনের কোনো জবাবদিহি নেই। জবাবদিহি নেই কারণ এ দুর্নীতিতে একেবারে উচ্চপদস্থ থেকে সর্বনিম্ন পর্যন্ত সবাই সম্মিলিতভাবে যুক্ত থাকে। বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ায় এসেছে মন্ত্রী থেকে সচিব পর্যন্ত সবাই এ সিন্ডিকেটের সদস্য। অর্থাৎ সবাই সম্মিলিতভাবে এখানে লুটপাট করে। যত বড় প্রকল্প তত বেশি লুটপাট। সুতরাং প্রকল্প কতটুকু প্রয়োজনীয় বা ভালো হচ্ছে নাকি খারাপ হচ্ছে সেটা দেখার থেকে তাদের আগ্রহ বেশি থাকে নতুন নতুন প্রকল্প শুরু করতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে জনপ্রশাসনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা যদি সংস্কার করতে সফল হন এবং যদি জবাবদিহির ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পারেন, তবে সেটা হবে রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় পুরস্কার।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

ফাহমিদা খাতুন: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রবৃদ্ধির সঠিক হিসাব। আমরা যে ধারার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলে আসছি, সেটার বাইরে যেতে হবে। আমরা দেখেছি রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় প্রবৃদ্ধি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। এখানে হয়তো রাজনৈতিক ফায়দা পাওয়া যায় কিন্তু আদতে সেটা সঠিক নীতি গ্রহণে বাধা প্রদান করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ জায়গাটায় সঠিক হিসাব জনগণের সামনে তুলে ধরুক এবং সঠিক নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিক।

একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষভাবে গড়ে তুলুক। দেশে মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, সরকার সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হোক।

গত ১৫ বছরে যে লুটপাট হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে সরকার অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হোক। এ সরকারের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে। তবে আমাদের হাতে সময় সীমিত। এই সীমিত সময়ের মধ্যে সরকারকে অনেক দিকে সংস্কার করতে হবে। আমি আশা করি, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ক্ষতগুলোকে নিরাময় করে একটি সুন্দর দেশ উপহার দিতে পারবে।