Published in সকালের খবর on Thursday, 23 February 2017
বাংলাদেশে বিনিয়োগকে নিরাপদ ভাবছে রাশিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক:
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশের সঙ্গে ১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি করেছে রাশিয়া। দুই দেশের মধ্যে ১৩ দফা আলোচনার ভিত্তিতে সম্পাদিত এ চুক্তিতে ৪৭টি অনুচ্ছেদ ও ৫৭৩টি উপ-অনুচ্ছেদ রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই কেন্দ্র নির্মাণ করবে রুশ প্রতিষ্ঠান। এই বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে দুই দেশ তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বহুদূর এগিয়ে নিতে চায়। সেই সঙ্গে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এখন বিনিয়োগের নিরাপদ জোন মনে করছে রাশিয়া। বাংলাদেশও রাশিয়াকে বড় বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে দেখতে চায়। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দেশের আর্থিক অগ্রগতির দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে উত্সাহিত করতে নিচ্ছে নানা পদক্ষেপ। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রক্রিয়াগুলো আরও সহজতর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রফতানি বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি নিকট প্রতিবেশী দেশ যেমন-ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীনও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে এসব দেশ টেক্সটাইল, ব্যাংকিং এবং টেলিকম শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের বাজারে এসব দেশের উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ বাড়ানো দেখে রাশিয়াও তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে ২০১৫ সালে বলেছিলেন, অর্থনৈতিকভাবে শিগগিরই বাংলাদেশ ‘এশিয়ার পরবর্তী টাইগার’ হচ্ছে। গত ৮ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ ৭ শতাংশের কাছে। আর ২০২০ সাল নাগাদ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে নিতে চায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাশিয়া বন্ধুত্বের হাতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে অবদান রাখতে চায় রাশিয়া। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থিক সঙ্গী হতে চায় দেশটি।
বাংলাদেশে রাশিয়ার বিনিয়োগ আগ্রহকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সকালের খবরকে বলেন, বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিনকে দিন বাড়ছে। কয়েক বছর আগে যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা ভাব দেখা দিয়েছিল তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় সব দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আর্থিকভাবে যখন ব্যাপক লোকসানে পড়ে তখনও কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো ছিল। এটা সবার নজর কেড়েছে। তা ছাড়া বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। আর এসব কারণে চীন-জাপান থেকে শুরু করে অনেক দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসছে। ঠিক একই কারণে রাশিয়াও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। তিনি বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু দেশ। তা ছাড়া বৃহত্ অর্থনৈতিক শক্তিও। রাশিয়ার মতো দেশ বিনিয়োগ বাড়ালে সেটা বাংলাদেশের জন্য খুবই ভালো।
সম্প্রতি বাংলাদেশ-রাশিয়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম বলেন, রাশিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্ক দিনকে দিন বাড়ছে। দুই দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতগুলোর সঙ্গে সমঝোতা বাড়ছে। তারই অংশ হিসেবে আমরা দেশের ইতিহাসে একক সর্ববৃহত্ ১২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ চুক্তি করেছি। এ ছাড়া গ্যাসপ্রম কোম্পানি বাংলাদেশের গ্যাস খাতের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। এভাবে আমরা দেশটির সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক আরও বাড়াতে চাই।
বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১৩ সালে ২৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ চুক্তি করে রাশিয়া। বাংলাদেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিচ্ছে রুশ প্রতিষ্ঠান এএসই গ্রুপ অব কোম্পানি। বিদ্যুেকন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের কাজ ইতোমধ্যে অনেক এগিয়েছে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষেই শুরু হবে মূল কেন্দ্র নির্মাণের কাজ। এই পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রে দুটি ভিভিইআর পাওয়ার ইউনিট থাকবে। যার একেকটির বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে প্রথম ইউনিটটি উত্পাদনে যাওয়ার কথা ২০২২ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি উত্পাদনে যাওয়ার কথা ২০২৩ সালে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, যার ৯০ শতাংশ দেবে রাশিয়া সরকার।
ইতোমধ্যে বিনিয়োগের সেরা গন্তব্য হিসেবে গড়তে বেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তা ছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য রয়েছে ট্যাক্স হলিডে সুযোগ। যার বড় উদাহরণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র। এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজের বিভিন্ন উপকরণ আমদানিতে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স সুবিধা, আমদানি শুল্ক এবং সাপ্লিমেন্টারি ডিউটির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর এসব সুবিধাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় রাশিয়া।
সামরিক খাতেও সহযোগিতা : রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক খাতেও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে রাশিয়ার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানির মহাপরিচালক স্পুটনিকে বলেন, বাংলাদেশ আমাদের নিয়মিত ক্রেতা দেশ। দেশটি আমাদের কাছ থেকে কেনা বিটিআর-৮০ সাঁজোয়া যান জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষার কাজে ব্যবহার করছে। এ বছরই অর্থাত্ ২০১৭ সালের মধ্যেই চুক্তিকৃত ৩৩০টি সাঁজোয়া যান বিটিআর-৮০ হস্তান্তর সম্পন্ন করবে রাশিয়া। আবুধাবিভিত্তিক স্পুটনিকে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ২০১৪ সালে সামরিক যান আমদানির চুক্তি করা হয়। ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিটিআর-৮০ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিগুলো এ বছরের মধ্যেই হস্তান্তর সম্পন্ন হবে।