Originally posted in কালবেলা on 23 March 2023
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, বর্তমানে রাষ্ট্রকে অভিজাত সমাজ কুক্ষিগত করছে। তারাই সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। সেখানে মধ্যবিত্তরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। এমনকি তারা সমাজে অগ্রণী ভূমিকাও রাখতে পারছে না।
গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) মিলনায়তনে ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ; পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্তের বিকাশ’ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন।
রেহমান সোবহান বলেন, অভিজাত শ্রেণির কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে মধ্যবিত্তরা দিনকে দিন অনেক পিছিয়ে পড়ছে। দেশে বেসরকারি শিক্ষার প্রসার লাভ করা সত্ত্বেও তারা সেই সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছে না। বরং তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারছে না; কিন্তু অভিজাত শ্রেণির সন্তানদের অনেকে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করছে। কেউ কেউ দেশের বাইরে পড়াশোনা করছে। তিনি বলেন, ৭৫-পরবর্তী সময়ে দেশের মধ্যবিত্তরা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগছিল। তাদের মধ্যে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন; কিন্তু পরে পরিস্থিতি অন্য রূপ নেয়। মধ্যবিত্তরা তাদের অধিকার হারাতে থাকে এবং একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে সমাজের কর্তৃত্ব চলে যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেখা যায় মধ্যবিত্তরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকে; কিন্তু পরে তারা আর সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি।
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, ’৭১-পূর্ববর্তী সময়ে দেখা যেত, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক ধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। তখন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অগ্রভাগ ছিল। কারণ, সেই বৈষম্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছি; কিন্তু এখন সমাজে অন্য ধরনের বৈষম্য দেখা যাচ্ছে, যা ক্রমবর্ধমান।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের মূল ভাগেই ছিলেন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তরা। নেতৃত্বে থাকা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রামে সঙ্গে, কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে ছিল গভীর সংযোগ। এই সংযোগ নিশ্চিত করতে যারা মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাদের মধ্যে অন্যতম। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল টানাপোড়েনের মধ্যে। তারা ছিল সামাজিক জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়লেও তারা সাংস্কৃতিক চেতনায় নিমজ্জিত নয়। এখনকার মধ্যবিত্ত অনেক বেশি অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক হলেও কম সাংস্কৃতিক। মধ্যবিত্তরা স্ববিরোধী। টানাপোড়েনে কেউ নিচে নামে, আবার কেউ ওপরে ওঠে। তবে গ্রামের সঙ্গে মধ্যবিত্তের সংযোগের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় উন্নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও বিপ্লব ঘটেছে। তবে শিক্ষার গুণগত মানের দিক থেকে আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। এ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি ২১টি জেলার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, অর্থনীতির বড় সহায়ক দেশের কৃষি খাত। কৃষিই বাংলাদেশের মূল রক্ষাকবচ। এজন্য এ খাতকে আধুনিকায়নসহ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়াতে হবে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের কৃষি তথা কৃষকদের অবদান ছিল।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, ৬০-এর দশকে মাত্র ৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। তারা আন্দোলন সংগ্রামে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল; কিন্তু এখন মধ্যবিত্ত প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু এর পরও তখনকার মতো ভূমিকা কেন রাখত পারছে না—এটি একটি বড় প্রশ্ন।