Originally posted in সমকাল on 17 November 2022
বেকারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও চওড়া
বাবা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে আসনাদ আহমেদ সজলকে পড়িয়েছেন রাজধানীর বনেদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথে। পড়ার সাবজেক্ট আরও লোভনীয়- কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই)। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রি হাঁকিয়ে তিনি শেষমেশ চাকরি নিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডের তৃতীয় শ্রেণির ‘কম্পিউটার অপারেটর’ পদে। ওই পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল নূ্যনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাস। পিলে চমকানো তথ্য হলো- এই পদে নিয়োগ পেয়ে যাঁরা গত অক্টোবরে কাজে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের ২০ শতাংশই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ‘কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’। সিএসই বিষয়ে পড়াশোনা করে সজলের পথে হেঁটেছেন মো. ফয়সাল হোসেন, মো. গোলাম রাব্বী, মৃণাল দেবনাথ, লাকী সুলতানা লাভলী ও আল আমিন হোসেন বিপ্লব। শুধু তা-ই নয়, এই নিয়োগে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে যাঁরা সরকারি চাকরি জুটিয়েছেন তাঁদের ৮০ শতাংশই দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
সজল, ফয়সাল, লাভলীদের মতো উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চাকরির বাজারে নেমে ধাক্কা খাচ্ছেন অনেকেই। তেমনই একজন নীলফামারীর বাদশা মিয়া। গত ২০ সেপ্টেম্বর ফেসবুক লাইভে এসে নিজের শিক্ষাজীবনের সব সনদ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বেকারত্বের রোষ মেটান। লাইভে তিনি বলেন, চাকরির বয়সই তো শেষ, সনদ রেখে লাভ কী? আরেক বেকার কবিরুল ইসলাম শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের দক্ষতা থাকার পরও চাকরি পাচ্ছেন না। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্ষেপ নিয়ে লেখেন- “‘তোমার সিভিটা আমাকে দিও, দেখি কী করতে পারি।’ -বেকারত্ব নিয়ে সবচেয়ে বড় মিথ্যে আশ্বাস ও সবচেয়ে বড় উপহাস এটি।”
দেশে বেকারের সংখ্যা কত? এ নিয়ে বরাবরই আলোছায়া। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার তথ্যের মধ্যেও থাকে বেশ ব্যবধান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে- দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। তবে ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বেকার সংখ্যা তিন কোটি। অনেক আগে থেকেই দেশের চাকরি বাজার দুর্বিপাকে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পণ্যদামের বড় ঝাঁকুনি, ডলার সংকটসহ নানামুখী চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। সেই সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে খোলাখুলি বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কার কথা। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থগিত হচ্ছে প্রকল্প। সরকারি-বেসরকারি দুই পর্যায় থেকেই বিনিয়োগ কমছে। বিনিয়োগই কর্মসংস্থানের আঁতুড়ঘর, ফলে মূল উৎসে ধাক্কা লাগায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। গত প্রায় দুই দশকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ইতিবাচক ধারায় থাকার পরও ক্রমবর্ধমান বেকার পরিস্থিতি স্বস্তির ছিল না। করোনা পরিস্থিতির ধকল না কাটতেই অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা সামনে রেখে বেকারদের কপালের ভাঁজ এখন আরও চওড়া।
সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেকারত্বের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, কিশোর গ্যাং, মাদক, ছিনতাইসহ নানামুখী সমস্যা দেখা দেয়। বেকারত্ব নিয়ে বাংলাদেশে নেই সঠিক কোনো পরিসংখ্যান। ফলে এ সমস্যা সমাধানে সরকার কী উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটার পরিস্কার প্রতিচ্ছবি নীতিনির্ধারণী মহলেও নেই। তাই বেকারত্ব তাড়াতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকেই দেওয়া হয় সব মনোযোগ। তবে অর্থনৈতিক মন্দার এ সময়ে সেই ভাবনাও হালে পানি পাচ্ছে না।
বেকার নিয়ে হরেক কথা: বেকারত্বের সংজ্ঞা ও হার নিয়ে প্রচার রয়েছে রকমারি কথা। এ অবস্থায় বেকারত্বের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশে যে উপায় ও সংজ্ঞায় বেকারত্ব নিরূপণ করা হয়, সে সংজ্ঞা অচল এবং অবাস্তব।’
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে বেকারত্বের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে- ‘১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে, যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজ করেনি।’ তবে অর্থনীতিবিদরা এই সংজ্ঞার সঙ্গে একমত নন। তাদের দাবি, এই সংজ্ঞা বাংলাদেশে বেকারত্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আংশিক কর্মসংস্থান সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এই সংজ্ঞা মোট দেশজ উৎপাদনের অন্য উপাদানের মধ্যকার মৌলিক ভারসাম্যহীনতাকেই প্রতিফলিত করে।
বিবিএস সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের (২০১৬-১৭) হিসাব বলছে, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছেন ৫ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৮০ হাজার। বিবিএস সূত্র জানিয়েছে, শ্রমশক্তি জরিপ চলমান আছে। পরবর্তী জরিপ প্রকাশ হবে ২০২৪ সালে।
তবে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এ দেশে বেকারত্বের যে হার দেখানো হয়, সেটা সঠিক নয়। এ মুহূর্তে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী যে সংখ্যক যুবক আছেন, তাঁদের তিনজনে একজন বেকার। শিক্ষিত বেকার হয়তো দুইজনে একজন।’
দেবপ্রিয়র এই তথ্যের সঙ্গে মিল রয়েছে লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ)। সংস্থাটির তথ্য মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দু’জনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে করোনা মহামারি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) হিসাবে, করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারিয়েছেন অন্তত দেড় কোটি মানুষ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার কারণে দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন অন্তত ৫ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে চারজন করে সদস্য)।
বেসরকারি আরেক হিসাবে, করোনাকালে ৩৫ লাখ থেকে সাড়ে ৬ কোটি মানুষ নতুন করে বেকার হয়েছেন, যাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বলা হয়, তাঁদের বেশিরভাগ করোনা মহামারিতে চাকরি কিংবা কাজ হারিয়ে, বেতন কমে দরিদ্র অবস্থানে এসে পড়েছেন। একে ‘আংশিক বেকারত্ব’ বলা হচ্ছে। তাঁদের কারও কাছে চেয়ে কিংবা হাত পেতে নেওয়ার অভ্যাস নেই। করোনা-পরবর্তী গত এক বছরেও তাঁরা আর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারেননি।
বিনিয়োগে গতি কম :পাঁচ বছর ধরে মোট দেশজ উৎপাদানের (জিডিপি) অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে আছে। প্রতি বছর বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা বাড়ছে, তবে অর্থনীতির আকার বিবেচনায় সেটি একই রকম। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী স্তরে যেতে হলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপি অনুপাতে ৩০ শতাংশের ওপরে নিতে হবে।
সরকারি চাকরি ‘সোনার হরিণ’ :প্রতি বছর সরকারি চাকরির চাহিদা যেভাবে বাড়ে, সেভাবে পদ সৃষ্টি হয় না। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করার ঘোষণা দেওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৫০ হাজারের মতো নতুন পদ সরকারি খাতে যোগ হচ্ছে। বিপরীতে প্রতি বছর চাকরি বাজারে ঢুকে শুধু অনার্স-মাস্টার্স করা ২০ লাখের ওপরে প্রার্থী। সেই সঙ্গে পুরোনো বেকার তো রয়েছেনই। সব মিলিয়ে সরকারি চাকরি এখনও ‘সোনার হরিণ’।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ ‘বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের পরিসংখ্যান, ২০২১’-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি পদের সংখ্যা ১৯ লাখ ১৩ হাজার ৫২টি। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫ পদ। অর্থাৎ বেসামরিক খাতে কর্মরত আছেন ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন।
সরকারি চাকরিতে সবচেয়ে বেশি পদ সংরক্ষিত আছে তৃতীয় শ্রেণিতে। এ পদে মোট পদের সংখ্যা ১১ লাখ ৯ হাজার ৫১৫টি, যা বেসামরিক খাতে মোট সরকারি চাকরির ৬২ শতাংশ। তৃতীয় শ্রেণিতে বর্তমানে কর্মরত কর্মচারীর সংখ্যা ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৯৬৭ জন, এতে শূন্য পদ আছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৪৮।
সরকারি চাকরিতে চতুর্থ শ্রেণিতে মোট পদ আছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭৭২, যা মোট সরকারি পদের ১৫ শতাংশ। বর্তমানে এ পদে কর্মরত আছেন ২ লাখ ৩১ হাজার ৯২ জন, এতে শূন্যপদ আছে ১ লাখ ২২ হাজার ৬৮০।
সরকারি চাকরির সবচেয়ে কম পদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে। এতে পদ আছে ২ লাখ ১০ হাজার ৭৫০, যা মোট সরকারি চাকরির ১১ শতাংশ। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ১৮৯ জন, অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণিতে শূন্য পদের সংখ্যা আছে ৪০ হাজার ৫৪১।
সরকারি প্রথম শ্রেণিতে পদ আছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ১৫। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৯ জন, বিপরীতে পদ খালি আছে ৪৩ হাজার ৩৩৬।
তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী: সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৃতীয় শ্রেণির চাকরি বাগাতে রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়েন বাঘা বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। ওই নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি পরিচালক (প্রশাসন) মো. রাহেদ হোসেন বলেন, শুধু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর নয়, সরকারি সব চাকরির পরীক্ষায় একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। চাকরির বাজার খারাপ ও উচ্চ শিক্ষার বেহাল দশাই এর অন্যতম কারণ। এসএসসি ও এইচএসসির নূ্যনতম যোগ্যতা চাওয়া হলেও আবেদন করা ৮০ শতাংশ আবেদনকারী অনার্স ও মাস্টার্স পাস। এর আগে ক্যাডার বা নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় দেখা যেত। এখন তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতেও তাদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য: এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক বছর সরকারি নিয়োগে স্থবিরতা ছিল। করোনা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি নিয়োগ শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা খোঁজ নিলে দেখবেন, প্রতি শুক্র ও শনিবার অনেক সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে। একই দিনে অনেকগুলো পরীক্ষা হওয়ার কারণে বেকার যুবকরা অভিযোগ করছে, তাদের অনেক নিয়োগ পরীক্ষা বাদ দিতে হচ্ছে। তাই দ্রুতই সরকারি শূন্য পদ পূরণ হয়ে যাবে আশা করি।’