Originally posted in bdnews24 on 4 May 2025
কমিশনের সুপারিশে আশায় শ্রমিক, সত্যি রেশন মিলবে?
মাথাপিছু রেশনের পরিমাণ কতটা হবে, সুপারিশ বাস্তবায়নে বছরে কত টাকা লাগবে, অর্থের যোগান কোথা থেকে আসবে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কে পালন করবে– এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।

কমিশনের সুপারিশে আশায় শ্রমিক, সত্যি রেশন মিলবে?কারখানা মালিকরা বলছেন, শ্রমিকদের জন্য রেশন
তৈরি পোশাক খাতের কর্মীদের সবচেয়ে চাপের সময়টি যায় মাসের শুরুতে। বেতন হয় ৭ থেকে ১০ তারিখে। তার আগ পর্যন্ত কোনোভাবে টেনেটুনে চালিয়ে নিতে হয় সংসার। বিশেষ করে খাবারের যোগান হয় বড় ভাবনার বিষয়। গ্রামের বাড়িতে থাকা আপনজনরাও মুখিয়ে থাকেন, কবে বেতন হবে।
এমন বাস্তবতায় পোশাক শ্রমিকদের জন্য রেশন চালুর আলোচনায় আশার আলো দেখছেন মাসরুফা ইয়াসমিন। তিনি ভাবছেন, মাসের প্রথম সপ্তাহে রেশন পেলে ওই দুশ্চিন্তা অনেকটা কেটে যাবে তার।
গাজীপুরের গ্রামীণ ফ্যাশনসের হেল্পার হিসেবে কাজ করা এই নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় ভালা হইবো রেশন দিলে। রেশন পাইলো মাসের প্রথম কয়ডা দিন তো ডাইল-ভাত খাওনের ব্যবস্থা নিয়া ভাবতে হইব না।”
চাহিদা অনুযায়ী ও নির্দিষ্ট সময় পরপর মজুরি বৃদ্ধি না হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত কয়েক বছর ধরেই শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। মূল্যস্ফীতি গতবছর দুই অংকে পৌঁছে যাওয়ার পর সেই দাবি আরো জোর পায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে এখন চলছে সংস্কারের ডামাডোল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনেও সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় শিল্পাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় শ্রমিকদের জন্য কার্ডভিত্তিক রেশন দেওয়ার সুপারিশ এসেছে।
মাথাপিছু রেশনের পরিমাণ কতটা হবে, সুপারিশ বাস্তবায়নে বছরে কত টাকা লাগবে, অর্থের যোগান কোথা থেকে আসবে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কে পালন করবে– এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।
পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এমন সুপারিশের বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তবে একটি বিষয়ে তারা একমত, সেটা হল– বিদেশি মুদ্রা অর্জনের প্রধান এই খাতে শ্রমিকের দুর্দশা লাঘব করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
কারখানা মালিকরা বলছেন, রেশন দেওয়ার মত সক্ষমতা তাদের নেই। সরকার চাইলে তবেই এমন সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব। আর সরকার এ বিষয়ে এখনো কিছু ভেবে উঠতে পারেনি।

রেশন কেন দরকার
২০১৬ সালে এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় দেখানো হয়, পোশাক শ্রমিকদের মোট আয়ের ৭২ শতাংশ চলে যায় খাবার আর বাসা ভাড়ার পেছনে।
অর্থাৎ, মাসিক আয় ১৫ হাজার ৭২০ টাকার হিসাবে ১১ হাজার ৩১৮ টাকাই চলে যায় এ দুই খাতে।
গ্রামের স্বজনদের কাছে পাঠাতে পারেন গড়ে ১১ শতাংশ। অবশিষ্ট অর্থে চিকিৎসা, শিক্ষা ও দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হয়।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশে পাশে থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় গতবছর। দক্ষিণ এশিয়ায় এই হার সর্বোচ্চ।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে শ্রমজীবী মানুষ। এই চাপ কমাতে রেশন চালু একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খাদ্য মূল্যস্ফীতির জন্য তো শ্রমিক দায়ী না। এটা রাষ্ট্রের নৈতিক দায় তাদের রেশন দেওয়ার। শ্রমিকরা রেশন পেলে তাদের পুষ্টি বাড়বে, যা উৎপাদন বাড়াতে সহায়াক হবে।”
বর্তমানের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধনী, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রভাব ফেলছে মন্তব্য করে মোস্তাফিজ বলেন, “মানুষের জীবনে খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। দেশে এটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে যে, সার্বিক ও খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে কোন শ্রেণির মানুষের ওপর কেমন প্রভাব পড়ে। শ্রমিকরা দরিদ্র শ্রেণির হওয়ায় তাদের রেশন দিলে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, শ্রম অসন্তোষ কমবে।”

প্রায় ৪০ লাখ কর্মীর তৈরি পোশাক খাতের অধিকাংশ শ্রমিক গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন চাকরির জন্য। শহরে কাজ করে যে আয় তারা করেন, সেখান থেকে পরিবারের কাছে অর্থ পাঠিয়ে গ্রামীণ জনপদের দারিদ্র্য নিরসনেও ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্পের অবদান ২১ শতাংশ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। শিল্পের ৫০ শতাংশই উৎপাদন খাতের, আর উৎপাদনের ৮০ শতাংশ অবদান তৈরি পোশাক শিল্পের।
সুতরাং দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই পোশাক খাতের শ্রমিকদের রেশন দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।
কারখানায় অনেক সময়ে কাজ থাকে না। বেকার থাকার সময় রেশন পেলে তা ‘বড় সহায়তা’ হবে বলে মনে করেন সাভারের জেড অ্যাপারেলসের মেশিন অপারেটর জাকির সরদার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তিন মাস বেকার ছিলাম। হাজিরা মজুরিতে যে কাজ পাইছি তাই করছি। গত ২৬ তারিখে একটা চাকরি পাইলাম। রেশন দিলে তো একটু কষ্ট কমত।’’
নবী নগরের বিএফএসএল কারখানার সুইং আপারেটর নাজমুন নাহার এবং তার স্বামী দুজনেই কাজ করেন গার্মেন্টেস কারখানায়। বড় মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ে। নিজেদের খাওয়া থাকার সঙ্গে মেয়ের শিক্ষার খরচ যোগানো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নাহার বলেন, “প্রতিটা টাকা হিসাব করে চলতে হয়, নাইলে মেয়ের খরচা দিতে পারি না। এক টাকার রেশন দিলেও তো একটু সুবিধা হয়।”
গ্রামীণ ফ্যাশনসের মাসরুফা ইয়াসমিনের স্বামী মাহফুজুল আলম তৈরি পোশাক খাতে কাজ করছেন প্রায় এক যুগ। রেশন চালুর খবরে তিনি কিছু সঞ্চয়েরও আশা দেখছেন।
ডরিন ওয়াশিং প্ল্যান্টের কর্মী মাহফুজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যা-ই পাই, তাই লাভ। অহন তো দুই পোলা-মাইয়া নিয়ে কষ্টে চলি। খরচ সামাল দিতে তাগো (দুই সন্তান) ঢাহায় রাহি না। গ্রামে দাদির কাছে থাকে। বউ আর আমি দুই জনের ইনকামে ৫ জনের সংসার চলে।
“রেশন দিলে যা বাঁচব, তা ব্যাংকে থুমু। এক হাজার টাকাও দিলে তো একটা ভবিষ্যত (সঞ্চয়) হইব।”

কত টাকা লাগবে? কোথা থেকে আসবে?
রেশন দিতে বছরে কত টাকা লাগবে তা নিয়ে এখনো কোনো ধারণাপত্র তৈরি করেনি কোনো পক্ষ। তবে রাজধানীর একটি সেমিনারে এ বিষয়ে নিজের পর্যব্ক্ষেণ তুলে ধরেছিলেন বিনায়ক সেন।
তিনি বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত রেশন দিতে পারলে জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক থাকবে।
“রেশন বাবদ শ্রমিক প্রতি অন্তত এক হাজার টাকার ভর্তুকি দিলে মাসে ৪০০ কোটি টাকা লাগবে। বছরে যা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার মত। সরকার জাতীয় বাজেটে এ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিতে পারে টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) মাধ্যমে।’’
মোটা দাগে বললে রেশন বাবদ সরকারকে প্রতি বছর বাজেটে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হবে প্রাথমিক পর্যায়ে। এখন এই অর্থের উৎস কী হবে, সে বিসয়ে কোনো প্রস্তাব করেনি সরকার, শ্রমিক পক্ষ বা শ্রমিক সংগঠনগুলো।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন মনে করেন, রেশনের জন্য অর্থায়নে সরকারকে আয় বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে বা অন্য কোনো ভর্তুকি কমিয়ে দিয়ে সেই অর্থ এ খাতে কাজে লাগাতে হবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভর্তুকি বাড়ানোর সুযোগতো এখনকার বাজেটে খুব একটা নেই। বরং আইএমএফ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর পরামর্শে সরকার ভর্তুকি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এখন রেশন হিসেবে খাদ্য বা ক্যাশ টাকা যাই দেওয়া হোক, সেই অর্থের যোগান দিতে অন্য কোনো ভুর্তকি কাটছাঁট করে আনতে হবে।’’
রেশন বা নগদ অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ব্যবস্থাপনায়; অর্থাৎ প্রকৃত সুবিধাভোগীর কাছে তা পৌঁছানোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সরকারের অর্থ প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব একটি সংস্থাকে পালন করতে হবে।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, কারখানা মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টিসিবির মাধ্যমে এই রেশন দেওয়া যেতে পারে।
তবে জাহিদ হোসেন বলছেন, বিশাল এই শ্রমঘন শিল্পে রেশন সংগ্রহ, কেনাকাটা, ওয়্যার হাউজে পাঠানো ও সবশেষ কারখানা গেইটে পৌঁছানোর মত বিরাট কর্মযজ্ঞ চালানোর সক্ষমতা টিসিবির নেই।
তাছাড়া ৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা পৌঁছে দিতে আরো কত টাকা খরচ যোগ হবে, তারও কোনো গবেষণা নেই।
“সাধারণ কথায় বললে প্রস্তাবটি ভালো শোনায়। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে, অর্থের উৎস কী হবে, টাকা বা খাদ্য যাই দেওয়া হোক না কেন, তার সুফল অর্থনীতিতে কী হবে। এসব নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হওয়ার পরই বিষয়টি বিবেচনার যোগ্যতা রাখে,” বলেন জাহিদ।
অন্যদিকে সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন যেখান থেকে হয়, রেশনের খরচও সেখান থেকেই নিতে হবে।
যা বলছে মালিক পক্ষ ও সরকার
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মেনে সরকা যদি সত্যিই পোশাক কর্মীদের জন্য রেশন চালুর উদ্যোগ নেয়, কারখানা মালিকরা সেখানে কীভাবে অংশীদার হতে পারেন?
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলছেন, তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সেই সক্ষমতা পুরোটা নেই।
“বেশিরভাগ সরকারকেই দিতে হবে। আমরা মালিকপক্ষ তাতে অংশ নিতে পারব। সেটা আলোচনা করেই করা সম্ভব বলে মনে করি।”

আরেক উদ্যোক্তা ওয়েল ডিজাইনারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার পর আমাদের সেই সক্ষমতা নেই সার্বিকভাবে। কেউ কেউ অংশ নিতে পারবে, সবাই পারবে না। পুরো দায়িত্বটা সরকার নিলে ভালো। কারখানা মালিকরা তো মুনাফার একটি অংশ প্রতিবছর সরকারের শ্রমিক উন্নয়ন তহবিলে জমা করছে।’’
শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য ও মেট্টোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআিই) সভাপতি কামরান টি রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে মালিক-শ্রমিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতাসহ সবার সঙ্গে কথা বলে এর বাস্তবায়ন করতে হবে।
“রেশনের বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেছেন। এখন সরকার মূল্যায়ণ করে দেখতে পারে। তখন বাস্তবায়নের বিষয়টি আসবে।”
সরকারের সিদ্ধান্তের পর অর্থের যোগান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম সংস্কার কমিশন অনেকগুলো সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার বিষয়টিও আছে, আরও অনেক কিছু আছে। মে দিবস পার হওয়ার পর আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে বসে যেটা যেটা বাস্তবায়ন করা যায় করব।”