কারখানা বন্ধে শ্রমিকের জীবনমানের অবনতি ঘটছে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in সময় নিউজ on 17 September 2025

বন্ধ পোশাক কারখানা, সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা বেকার শ্রমিকদের

ব্যয়ের চাপে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষ যখন দৌড়াচ্ছে কাজের সন্ধানে তখন আরও কর্মহীন হয়ে পড়ার তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। গত ১৩ মাসে বন্ধ হয়েছে শুধু এই একটি সংগঠনের সদস্যভুক্ত ১৫৪টি রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা; কাজ হারিয়েছেন এক থেকে দেড় লাখ শ্রমিক।

কর্মক্ষম এসব মানুষের কাজের সুযোগ তৈরিতে সরকারকে এগিয়ে আসার তাগিদ শ্রমিক নেতাদের। তবে রাজনৈতিক সরকার ছাড়া দেশে বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন না উদ্যোক্তারা। এদিকে আয়ের পথ বন্ধ হলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে চার মাস ধরে বেকার গার্মেন্টস কর্মী মৌসুমি। নিজের দৈন্যদশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অফিস তো চার মাসের মতোই বন্ধ। কিন্তু আমাদের তো খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে। কোথায় যাবো? কোনো অফিসে কাজ দিচ্ছে না। ঋণ করে এনে বাচ্চাদের খাওয়াই। এখন তো ঋণদাতারাও টাকা দিতে চায় না। বলে, তোমার চাকরি নাই, তুমি ফেরত দিবা কোথা থেকে?’

এদিকে সংসারের ব্যয়ের চাপ মাথায় নিয়ে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করেছেন মৌসুমীর স্বামী পোশাক শ্রমিক মনিরুল ইসলাম। কিন্তু সেই কাজও নিয়মিত জোটে না। প্রকৃতির বৈরিতায় আয় আরও অনিশ্চিত। মনিরুল বলেন, ‘রাজমিস্ত্রির কাজ গাছে ধরে না। যেমন ধরেন, আজকে বৃষ্টি হচ্ছে-আজ কাজ নাই, কাল কাজ নাই। দুইদিন, তিনদিন বসে থাকি। তারপর গেটের পর গেট ঘুরি, তাও লাভ নাই-লোক নেয় না।’

সচল কারখানাগুলোর সামনে গেলেই দেখা মেলে, চাকরির খোঁজে দিনের পর দিন হন্যে হয়ে ঘুরছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরির কর্মীরা। তারা বলেন, ‘ফ্যাক্টরির সামনে ঘুরতেছি, কিন্তু কোথাও নিয়োগ নাই। চাকরি হইতেছে না, আমাদের তো বাঁচতে তো হবে। কত মানুষ বেকার ঘুরতেছে। মেয়ে মানুষ তাও দুই একটা কাজ পায়, কিন্তু ছেলে মানুষ একদমই পায় না। কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের ভ্যাকেন্সি তো বন্ধ হচ্ছে না।’

স্থানীয়রা বলছেন, ‘কারখানা বন্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আশপাশের সব খাতেই। একটা ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে শুধু মালিকের ক্ষতি হয় না, সরকারের ক্ষতি হয়, জনগণের ক্ষতি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, বাসাভাড়া-সব জায়গায় সমস্যা দেখা দেয়।’

বিজিএমইএ বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শুধু তাদের সদস্যভুক্ত কারখানাই বন্ধ হয়েছে ১৫৪টি। এতে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ২ লাখ শ্রমিক। এর মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অন্য কারখানায় কাজ পেলেও বাকিরা থেকে গেছেন বেকার। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে আরও অন্তত ২০টি কারখানা।

এমন বাস্তবতায় কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান যেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার না হয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ যেন আর সংকুচিত না হয়; তা নিশ্চিতের দাবি শ্রমিক নেতাদের।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘কোনোভাবেই রাজনীতির কারণে যেন কারখানা বন্ধ না হয়ে যায়। দিন শেষে এই শ্রমিকরাই কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করার জন্য আমাদের সব স্টেকহোল্ডারকে একটা সোশ্যাল ডায়লগে আসা উচিত। যে লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে, তাদের নিয়ে আমাদের লং রানে চিন্তা করতে হবে; তাদের কোথায় গিয়ে আবার রিহ্যাবিলিটেট করা যায়। যেখানে কর্মসংস্থান আছে, সেখানে রিস্কিল বা আপস্কিল করার মতো সুযোগ তো সরকারকেই সৃষ্টি করতে হবে। এটা মালিকদের পক্ষে করা সম্ভব না।’

কারখানা বন্ধের পরিসংখ্যান উদ্বেগ বাড়ালেও উদ্যোক্তারা বলছেন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য জরুরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নির্বাচিত সরকার।

বিজিএমইএর পরিচালক মজুমদার আরিফুর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর বেশ কিছু ফ্যাক্টরি বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। সময়টা খুব কঠিন। কারণ বাংলাদেশে এখন একটা নির্বাচিত সরকার নেই। এখানে মানুষের নিশ্চয়তা কম থাকে। আপনি যতই ভালো থাকার চেষ্টা করুন বা বোঝাতে চান, কিন্তু বিশ্ব জানে এখানে কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। যেকোনো সময় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। ফলে তেমন কোনো ইনভেস্টমেন্ট আসছে না। এজন্য নির্বাচন আয়োজন খুব জরুরি। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য এটা দরকার। যদি ভালো নির্বাচন হয় এবং নির্বাচিত সরকার আসে, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ আবারও ইনশাল্লাহ গার্মেন্টস শিল্পে ভালো অবস্থানে যেতে পারবে।’

অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, ক্রমাগত কর্মসংস্থানের সুযোগ কমতে থাকলে সমাজে বাড়তে পারে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কিছু কারখানা স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সমস্যাটা তীব্র হয়েছে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হচ্ছে না। শুধু রেডিমেড গার্মেন্টস নয়, আরও অন্যান্য শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে এর সবচেয়ে বড় চাপ পড়ে শ্রমিকদের ওপরেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর ফলে শ্রমিকদের জীবনমানের অবনতি ঘটছে। এর সঙ্গে সামাজিক অভিঘাতও যুক্ত হচ্ছে, অনেক সময় অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই আমাদের প্রথম কাজ হবে বিনিয়োগে গতি আনা। উদ্যোক্তারা যাতে নতুন কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, আর বিদ্যমান কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে পারেন, সে ধরনের ব্যবসাবান্ধব বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।’

প্রকৃতির মতোই অনিশ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন। কখনো ঝড়-বৃষ্টি, কখনো ভোরের আলো ফোটার আগেই নেমে আসে কালো মেঘ। এর ভেতর আবার যখন দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাতেই কমে আসছে কর্মসংস্থানের সুযোগ, তখন চাপ বাড়ছে অন্যান্য খাতে। কিন্তু অন্য খাতগুলো কি এই বাড়তি চাপ নিতে প্রস্তুত?-এমন প্রশ্ন সামনে এনেই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর অর্থনৈতিক প্রত্যাশাকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে সুসংহত কর্মপরিকল্পনা সাজানোর তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।