Dr Debapriya Bhattacharya tells Samakal what crises the economy currently faces, published on Monday, 12 January 2015.
সংকট নিরসনে আলোচনা চান বিশিষ্টজন
বিশেষ প্রতিনিধি
আবার ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুশীল সমাজ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, জরুরি ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট সমাধান না হলে দৃশ্যপটে অনাকাঙ্ক্ষিত শক্তি এসে যেতে পারে; একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি গুরুতর সংকটের মুখে পড়বে।
ড. আকবর আলি খান :সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য হয়েছিল। ওই নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দিত। কিন্তু সংবিধানেই বলা হয়েছে,
প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই দেশ পরিচালিত হবে। বাস্তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের বড় অংশই ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। ফলে বাস্তবে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ধারাবাহিকতা রক্ষা ছাড়া সংবিধানের অন্য বড় লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়নি। নির্বাচনের পর সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি করেনি। ফলে সংকটেরও স্থায়ী সমাধান হয়নি। এখন সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে অবশ্যই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে, যার মাধ্যমে জনগণের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান :টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাংবিধানিক শূন্যতার হাত থেকে রক্ষার জন্যই এ নির্বাচন হচ্ছে। দ্রুততম সময়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু নির্বাচনের পর সরকার যেভাবেই হোক, এক ধরনের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। একই সঙ্গে একাদশ নির্বাচনের প্রসঙ্গ থেকেও সরে আসে। এ সময়ে বিএনপি জোটও গ্রহণযোগ্য একাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের দাবির প্রতি সুস্পষ্ট জনসমর্থন প্রমাণ করতে পারেনি। ফলে বছরজুড়ে এক ধরনের স্বস্তি থাকলেও বছর শেষে পুরনো সংকটই ফিরে এসেছে। সরকার যেমন বল প্রয়োগ করে বিরোধীদের সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, বিরোধীরাও তেমনি সহিংস কর্মসূচি দিচ্ছে। এর কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার এই অসুস্থ লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। জানমালের ক্ষতি হচ্ছে, দৈনন্দিন জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে, অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়ছে, প্রতিনিয়ত উৎকণ্ঠার ভেতরে দিন কাটাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এ ধরনের পরিস্থিতি অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা দখলের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ সমকালকে বলেন, এক বছর আগে যে ধরনের সংকট দেখা গিয়েছিল, সেটাই আবার ফিরে এসেছে। এই সংকটে কারও লাভ হচ্ছে না, বরং ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের। সংকটের উৎস যেহেতু সবাই জানে, সে কারণে তার সমাধানের পথও সবাই জানে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরেই আজকের সংকট। কারণ ওই নির্বাচন সাংবিধানিক হলেও সবার অংশগ্রহণ ছিল না। এখন সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথও একটাই, সবার অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে নতুন একটি নির্বাচন করতে হবে। না হলে সাময়িক সময়ের জন্য স্থিতিশীলতা এলেও সংকট কাটবে না। সংকট বারবার ফিরে আসবে। এ বিষয়টি রাজনীতিবিদরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন এবং আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেবেন, ততই দেশের মঙ্গল।
ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম :সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তা থাকলে তা সমানভাবে উন্নয়ন ও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। যেমন, গত বছর রাজনৈতিক সহিংসতা না থাকলেও এমন অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়নি। চলতি বছর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে সহিংসতা যুক্ত হওয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন যেতে পারে_ এমন প্রশ্নে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা নেই। তবে এ কথাও ঠিক যে, যে অস্থির ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দেশ চলছে, তা বেশি দিন চলা উচিত হবে না। সবার প্রত্যাশা এই যে, এ বিষয়ে সরকারি দলের মধ্যে বোধোদয় হবে। যদি তারা সমঝোতার রাজনীতির বিষয়টি যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি না করেন বা হৃদয়ঙ্গম না করেন, তবে তা দেশের তথা দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জন্য ক্ষতি ডেকে আনবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সমকালকে বলেন, নির্বাচনোত্তর ২০১৪ সালে একটা আপাত শান্ত পরিস্থিতি ছিল। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যে খুব খারাপ ছিল, তা নয়। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল ছিল। রেমিট্যান্স পরিস্থিতিরও কিছুটা উন্নতি হয়। তবে এসবের ভেতরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হলো বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উজ্জীবিত না হওয়া। এ অবস্থায় নতুন বছরে সংঘাত-সহিংসতা যেভাবে শুরু হলো, তা দীর্ঘায়িত হলে সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে। শুধু বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে তা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে।
ড. জাহিদ হোসেন : বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, ২০১৪ সালে অর্থনীতির অবস্থা তার আগের বছরের তুলনায় ভালো ছিল। মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্সসহ অর্থনীতির কিছু সূচকে উন্নতি দেখা যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হলে অর্থনীতির জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হবে। গত নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়ে অর্থনীতিকে বেশ বেকায়দায় ফেলে। তিনি আশা করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধান রাজনৈতিকভাবেই হবে।
কাজী আকরাম উদ্দিন :ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, ২০১৩ সাল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য খুব খারাপ সময় গেছে। এর মূল কারণ সংঘাত-সহিংসতা। ২০১৪ সালে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা পোষানো গেছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ২০১৫ সালের শুরুতে আবারও অস্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। এফবিসিসিআই ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানিয়েছে। এফবিসিসিআই চায়, অর্থনীতিকে বাঁচানোর স্বার্থে আইন করে হলেও হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি বন্ধ হোক। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ২০১৪ সালে কারখানার পরিবেশ উন্নয়ন করে ধকল অনেকটা কটিয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তারা। পোশাক খাত যখন কমপ্লায়েন্সের ইমেজ সংকট কাটিয়ে নতুন সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে, তখন দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি এ খাতকে আবারও ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।