Originally posted in দেশ রূপান্তর on 9 September 2024
তথ্য গোপন করে সরকারকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ
মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে টাকার জোগান কমিয়ে সুদের হার বাড়াতে হয়, এটাই অর্থনীতির স্বাভাবিক রীতি। করোনাকালে ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির আঁচ বাংলাদেশেও লেগেছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ওই রীতি মেনে প্রায় সব দেশই সফল হয়েছিল, ব্যতিক্রম বাংলাদেশসহ দুয়েকটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তখন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি রোধে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হলেও ‘ইসলামি’ ব্যাংকগুলোকে নিয়মিতভাবে ধারে তারল্যের জোগান দেওয়া হয়েছে। ফলে অর্থনীতির অস্থিরতা এখন চরম পর্যায়ে। অর্থনীতিতে টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে গত ডিসেম্বরের ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি এখন ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এখন বিপদ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছে অন্তর্বর্তী সরকার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তথ্য গোপন করে ৬২ দিনে সরকারকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, নতুন ঋণ না নিয়ে ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা আগের দায় সমন্বয় করেছে সরকার। সাবেক গভর্নরের স্বেচ্ছাচারিতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলতে না পারলেও সরকার পরিবর্তনের পর তথ্য গোপন করে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়ার কথা এখন প্রকাশ পাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকার স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৭ কোটি। চলতি বছর জুনে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ২১ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। চলতি বছর জানুয়ারি-জুন সময়ে ৪৩ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা ছাপানো হয়, যার প্রায় পুরোটাই সরকারকে দেওয়া হয়।
গত বছরের মাঝামাঝি ‘ইসলামি’ ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে পুরো খাতেই তারল্য সংকট দেখা দেয়। এস আলম, সালমান এফ রহমান প্রমুখ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর বিপুল পরিমাণে বেআইনি ঋণগ্রহণের কারণে অন্তত ১০টি ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের বিশেষ নির্দেশে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সহায়তায় বেআইনিভাবে অর্থায়ন করা হয় ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে। এর প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অস্থিরতা দেখা দেয়। রিজার্ভ সংকটের কারণেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। তখন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সুদহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের পরামর্শে কান দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে বিগত সরকার ও সাবেক গভর্নর রউফের কাছে। পরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ও গ্রাহকের আস্থা দুটোই বিপদসীমা পার হয়ে যায়। আর এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ব্যাংক-লুটেরাদের তথ্য আসতে শুরু করায় দেশে অস্থিরতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে এ সরকারের ওপর সাধারণ আমানতকারীদের আস্থা থাকায় উদ্বেগ, আতঙ্ক সীমিত পর্যায়ে রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমানতের সুদহার এখন প্রায় ১৫ শতাংশ। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। এ সুদহারেও ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ ব্যাংকে নগদ টাকা না রেখে হাতেই রাখছে বেশি। ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট বেড়েছে। অর্থনীতিতে টাকার সরবরাহ কমায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর মে মাসে ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার পরিমাণ ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা বেড়েছে। মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, যা আগের মাসে ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ৩৪৯ কোটি। গত মে মাসের শেষে ব্যাংকগুলোর হাতে মাত্র ২০ হাজার ১৫১ কোটি টাকা ছিল, যা গত ২৩ মাসে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালের জুনে ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল ১৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকে নগদ টাকা রাখার পরিমাণ বেড়ে গত মার্চে সর্বোচ্চ ২৯ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এপ্রিল থেকে আবারও ব্যাংকে নগদ টাকা কমতে থাকে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্মার্ট সুদহার ব্যবস্থা বাতিল করে চলতি বছরের মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক সুদহারের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আমানতের সুদহার বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশের ওপর। কিন্তু সুদহার বাড়লেও ব্যাংকে নগদ টাকা জমার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অথচ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর মূল কারণ ছিল মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ কমিয়ে আনা। কিন্তু মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও কমছে না। গত জুলাইয়ে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৩-২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। যদিও সরকার চেয়েছিল মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে।
গত ১৩ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি আরও সংকোচনমূলক করা হয়। গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। এর ফলে সব ধরনের সুদের হার বেড়ে যাবে এবং ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার লক্ষ্যে নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি-এসএলএফ) ১০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং নিম্নসীমা (স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ) ৭ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে, সমাজে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সে কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বাড়ায় তারা। নীতি সুদহার বাড়ানোর অর্থ হলো, ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহারও বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়। নীতি সুদহারকে বলা হয় রেপো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে, তাহলে তারা ওই তারল্য তুলে নিতে পারে। তুলে নেওয়ার জন্য সুদের নির্দিষ্ট হার থাকে। অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে হারে সুদ দেয়, তাকে বলা হয় রিভার্স রেপো। রেপো রেটের তুলনায় রিভার্স রেপো রেট কম থাকে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনাতেও পড়তে শুরু করেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চয় ভেঙে চলতে হচ্ছে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে সেটির কার্যকারিতা কম। মুদ্রার সরবরাহ কমার চেয়ে বরং বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে সার ও বিদ্যুতের পাওনা বাবদ বিভিন্ন ব্যাংককে দেওয়া সরকারের বন্ড সুবিধা। টাকা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করতে না পেরে বিভিন্ন ব্যাংকের বিপরীতে বন্ড ইস্যু করেছে সরকার। ব্যাংকগুলো এ বন্ড জমা রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে।
আগামী ছয়-সাত মাসে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আগের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকার বা কোনো ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হবে না। তবে আর্থিক খাতে ভারসাম্য আনতে দুভাবে সহযোগিতা করা হবে। প্রথমত, কৃষি ও শিল্প খাতের জন্য সব কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে এবং দ্বিতীয়ত, মনিটারি পলিসিকে টাইট ফিস্টে রাখা হবে।
নিয়মিত মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করার কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে, এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। যথাযথ নীতি প্রণয়নের জন্য প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত দরকার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রথমত, অনেক সময় সরকারের অর্থ সংকুলানের জন্য টাকা ছাপানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কোনো কোনো ব্যাংকে তারল্য সংকট হয়েছে, তাদেরও টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন করা হয়েছে। এর ফলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা থাকে না। এর প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের বেশি টাকা দরকার হচ্ছে। এর ফলে নগদ টাকা হাতে রেখে মানুষ সাংসারিক ব্যয় মেটাচ্ছে। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, তার ব্যয় যাতে আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। যাতে টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন করতে না হয়।’