Originally posted in কালের কন্ঠ on 28 April 2022
আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে চূড়ান্ত বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রস্তাব করা হচ্ছে ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১৫.৪ শতাংশ। নতুন বাজেটে মহামারি-পরবর্তী সময়ে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় প্রান্তিক মানুষকে রক্ষা করতে কী ব্যবস্থা থাকা দরকার, স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় কেমন বাজেট হওয়া উচিত, অর্থনীতিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগকে কতটা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কেমন থাকা উচিত—এসব বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব ও আফছার আহমেদ
কালের কণ্ঠ: আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে ছয় লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছর থেকে ৭৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। এবারের সম্ভাব্য বড় আকারের বাজেটকে কিভাবে দেখছেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আমাদের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য বড় আকারের বাজেটের চাহিদা রয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। আমরা করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধার থেকে এখন প্রবৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এ প্রেক্ষাপটে বড় বাজেটের চাহিদা রয়েছে। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে পারে।
বড় বাজেট ঘোষণার একটি রাজনৈতিক অর্থনীতিও রয়েছে। কারণ বিভিন্ন ব্যয়কে এ ধরনের বড় বাজেটে সন্নিবেশিত করা যায়। অর্জনযোগ্য বা অর্জন অযোগ্য যাই হোক, সবই এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার এটাও ঠিক যে শুরুতেই বাজেট কাটছাঁট করে আনলে সব কিছু অন্তর্ভুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। বড় বাজেটের পেছনে এটাও ভূমিকা রাখতে পারে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত বাজেটের ব্যয় লক্ষ্যমাত্রার এক-পঞ্চমাংশই অর্জন করা যায় না। ফলে দেখা যায়, অনেক প্রকল্প ঝুলে থাকে এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সুতরাং বড় আকারের বাজেট ঘোষণা এক দিক থেকে বাজেট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দুর্বলতার একটি কারণ।
কালের কণ্ঠ: ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিক থেকে বাজেটকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আমরা প্রতিবছরই দেখতে পাই যে বাজেটে যাই থাকুক, বছর শেষে এর বেশির ভাগই অনর্জিত থাকে। যেমন—২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছিল ৮০.৯ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ শতাংশই অনর্জিত থাকে। এর পূর্ববর্তী বছরগুলোতেও কমবেশি একই চিত্র দেখা গেছে। এই অর্জন না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এর সঙ্গে সম্ভবত সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনর্জিত থাকার যোগসূত্র রয়েছে। এই অর্জনের মাত্রাটি বিবেচনা করে বাজেটের আকার বলতে মূলত সরকার অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস পর করা সংশোধনী বাজেটকেই মূল আকার হিসেবে গণ্য করতে চায়। ফলে সংশোধনী বাজেটের কতটুকু অর্জিত হয়েছে সেটিকেই লক্ষ্য অর্জনের নির্দেশক হিসেবে দেখে। ফলে বড় বাজেট ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবায়নের একটি ফারাক সব সময়ই থেকে যায়।
কালের কণ্ঠ: খাতওয়ারি বরাদ্দে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বাজেটের আকার বড় হয়ে ওঠার পেছনে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ রয়েছে। খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমরা এতে বড় কোনো পরিবর্তন দেখতে পাই না। বিদায়ি ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, সরকারি কর্মীদের পেছনে ১৯ শতাংশ, শিক্ষার পেছনে ১৬ শতাংশ, সড়ক ও পরিবহনে ১২ শতাংশ, সুদজনিত ব্যয় ১১.৪ শতাংশ, স্থানীয় সরকারে ৭ শতাংশ, প্রতিরক্ষায় ৬ শতাংশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এবারের সম্ভাব্য বড় আকারের বাজেটেও এই কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। তবে পাবলিক সার্ভিস বা সরকারি কর্মীদের পেছনে এত বড় ব্যয় প্রশ্নসাপেক্ষ। আমাদের সুদজনিত ব্যয়টাও দিন দিন ব্যয়ের বড় খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। যেমন—সুদজনিত ব্যয়ের জন্য আগামী অর্থবছরের জন্য সম্ভবত ৮১ হাজার কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। অথচ চলতি অর্থবছরে সুদজনিত ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। এটা বড় বাজেটের পেছনে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া পাবলিক সার্ভিসের বাইরে প্রতিরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এমন কিছু ব্যয় ঢুকে আছে, যা প্রকারান্তরে পাবলিক সার্ভিসের ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ারই কথা।
কালের কণ্ঠ : বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। অথচ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির তুলনায় এবার আরো কম ধরা হচ্ছে। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯.৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে তিন লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১.৩ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাড়ালেও রাজস্ব আদায়ের হার জিডিপির তুলনায় প্রায় ২ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর একটি কারণ হতে পারে বড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির কারণেই হয়তো শতাংশ হিসাবে আমরা কিছুটা কম পাচ্ছি। তবে এটাও ঠিক যে জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আয় বৃদ্ধির অনুপাতটি প্রকৃতার্থেই আরো বাড়ানো দরকার। আরেকটা বিষয় হতে পারে যে রাজস্ব আদায়ের কাঠামোতে বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না। অর্থাৎ রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য সম্ভবত নতুন কর বাড়ছে না। ফলে জিডিপির তুলনায় কম রাজস্ব আদায় হবে।
কালের কণ্ঠ: দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অনিশ্চয়তায়। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা লোকদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন করে দারিদ্র্যে পড়া লোকজন। মধ্যবিত্তের একটা অংশও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে বাজেটে কী থাকতে পারে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে বাজেট ও বাজেট-বহির্ভূত দুই ধরনের উদ্যোগই দরকার আছে। বাজেটীয় উদ্যোগের ভেতরে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি একটি উপায়। অবশ্য সরকার প্রতিবছর এর আওতা বাড়াচ্ছে—এটা ইতিবাচক। এ ক্ষেত্রে শুধু বয়স্ক, বিধবা, একক মা, স্তন্যদাত্রী মায়েদের নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতা বৃদ্ধিই নয়, অর্থের পরিমাণও বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন—বয়স্কদের জন্য ভাতা ৫০০ টাকার স্থলে ৬০০ টাকায় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এটা এক হাজার টাকা হওয়া উচিত। করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা হলে মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া যেতে পারে। তাহলে হয়তো তার প্রকৃত আয় বৃদ্ধির একটু সুযোগ থাকে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান সহায়ক সরকারি বিনিয়োগও বৃদ্ধি করা উচিত।
বাজেট-বহির্ভূত জায়গা থেকে বলব, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে নিয়মিত নজরদারি বাড়ানো উচিত। সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার কমিশনসহ বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা খুব দরকার। সরকারের আইনগত ও নীতিগত অবস্থান থেকে এদের শক্তিশালী করা দরকার।
কালের কণ্ঠ : আমাদের অর্থনীতির প্রধান তিনটি স্তম্ভ কৃষি, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি—এই তিন খাতের জন্য বাজেটে কী কী প্রস্তাব থাকতে পারে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: কৃষি খাতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে সারের ভর্তুকি অব্যাহত রাখা। এই মুহূর্তে সরকারকে গ্যাস আমদানি করতে গিয়ে প্রচুর ব্যয় করতে হচ্ছে, ফলে সারের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়তি যে টাকার প্রয়োজন হয় সেটা দিতে সরকারকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষকের উৎপাদন ব্যয় যদি কম হয়, তাহলে তা ভোক্তার জন্যও সাশ্রয়ী হবে। একই সঙ্গে ভর্তুকি মূল্যে সার পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালে আমাদের ধান উৎপাদন ১১ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। তাই কৃষিতে জলবায়ু অভিযোজনমূলক প্রকল্প নিতে হবে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায়।
রেমিট্যান্সের জন্য আড়াই শতাংশ ভর্তুকির যে ব্যবস্থা আছে সেটা অব্যাহত রাখতে হবে। এর সঙ্গে যা করা দরকার তা হচ্ছে কার্ব মার্কেটের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার এক্সচেঞ্জ রেটে পাঁচ থেকে ছয় টাকার পার্থক্য রয়েছে। এত বড় পার্থক্য থাকলে সরকারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনা কষ্টকর হবে। সুতরাং এ জায়গায় কিছুটা হলেও এক্সচেঞ্জ রেট সমন্বয় করার দরকার হতে পারে, যাতে প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে উৎসাহী হন।
আমাদের রপ্তানি খাত ভালো করছে। তবে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত দরকার। রপ্তানি খাতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয় সেটা একক খাতভিত্তিক। এর পরিবর্তন দরকার। অর্থাৎ পুরনো খাত থেকে অর্থ সরিয়ে এনে নতুন খাতকে ভর্তুকি দেওয়া। যেমন—তৈরি পোশাক খাতে ঢালাওভাবে ভর্তুকি না দিয়ে নতুন ধরনের পণ্য, যেমন—সিনথেটিক পণ্য, নন-কটন পণ্য উৎপাদন করার জন্য কেউ যদি প্রযুক্তি আনেন, যন্ত্রপাতি আনেন, কাঁচামাল আনেন অথবা রপ্তানি বৃদ্ধি করেন, তাহলে তার জন্য ভর্তুকি বা ক্যাশ ইনটেনসিভ দেওয়া দরকার। অথবা পরিবেশ উপযোগী মানসম্মত কোনো প্রযুক্তিতে যাওয়া অথবা পণ্যবহুমুখীকরণের জন্য কেউ যদি বিনিয়োগ করেন বা রপ্তানি করেন, তাঁদের ক্যাশ ইনটেনসিভ দেওয়া উচিত।
কালের কণ্ঠ : মহামারি ও মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে প্রান্তিক মানুষকে রক্ষা করতে বাজেটে কেমন বরাদ্দ থাকা দরকার বলে মনে করেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: করোনাকালে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজে এই শ্রেণির লোকদের আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতি সময়টাকে ধরে এই উদ্যোগটা আরো প্রলম্বিত করতে পারলে আরো ভালো হতো। প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ হিসেবে দলিত, হিজড়া, নারী ও শিশু, চরাঞ্চলের মানুষ, জলবায়ু উদ্বাস্তু, নদীভাঙনজনিত উদ্বাস্তু, দরিদ্র এথনিক গ্রুপ, শহরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী তথা বস্তিবাসী রয়েছে। সৌভাগ্য হচ্ছে, সরকার এরই মধ্যে এদের চিহ্নিত করছে। তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি বলব, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত করা দরকার, যা উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া এই শ্রেণির লোকজন যে এলাকাগুলোতে বসবাস করে, যেমন—নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা, চর এলাকা, উপকূলবর্তী এলাকা—বাজেটে এসব প্রান্তীয় এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ অবকাঠামো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষের দারিদ্র্য আরো বেড়ে যায়।
কালের কণ্ঠ: স্বাস্থ্য খাতে কেমন বরাদ্দ আশা করেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: কভিডের সময় এত আলোচনার পরও আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বড় পরিবর্তন আমরা দেখিনি। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ব্যবহারের সক্ষমতার একটা দুর্বলতা রয়েছে। এর ভেতরে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হচ্ছে কভিডের টিকাদান কার্যক্রম। নানা সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি সত্ত্বেও টিকা গ্রহণ উপযোগী ৭৬ শতাংশ মানুষ টিকা নিয়েছে—এটা সরকারের সফল কার্যক্রম। তবে কিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রেও বড় প্রশ্ন রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বড় দরকার হলো সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ জন্য কমিউনিটি সার্ভিস, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে আরো উন্নত করা দরকার ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর দিক থেকে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সাধারণ ও বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। এখানে স্বাস্থ্য খাতে বড় সরকারি বিনিয়োগের অভাবে আমাদের চিকিৎসা বেসরকারি ব্যবস্থার ওপরই বেশি নির্ভরশীল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় আফগানিস্তানের পর সর্বোচ্চ। এই খাতে সাশ্রয়ী সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
কালের কণ্ঠ: স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় কেমন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের স্বাভাবিক যে কাঠামো রয়েছে সেটা হচ্ছে কর ছাড়া এবং কিছু ক্ষেত্রে করারোপ। এর মাধ্যমে আমদানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেশে উৎপাদিত পণ্য বেশি সুবিধা পায়। এটা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের ভর্তুকীকৃত ঋণ (সাবসিডাইজড ক্রেডিট) কিভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যবস্থা করা দরকার। করোনা-পরবর্তীকালে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেক অর্থের প্রয়োজন। তার পক্ষে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া কঠিন। তারা ঋণ পায়ও কম। বাজেটে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দরকার। এ ছাড়া এসএমই ফাউন্ডেশন ও এনজিও যারা মাইক্রো এন্টারপ্রাইজে ঋণ দেয়, তারা যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসে সে জন্য সাবসিডাইজড ক্রেডিটের প্রভিশনটা সরকার চিন্তা করতে পারে। এটা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বেশি পরিমাণে দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ: গত দুই বছরে বিদেশফেরত, বেকার ও করোনায় চাকরি হারিয়েছে অনেক মানুষ। এ অবস্থায় অর্থনীতিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কী করা যেতে পারে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে বড় ভূমিকা পালন করে বেসরকারি খাত এবং এ ক্ষেত্রে সরকার অনুঘটকের ভূমিকায় থাকে। এই অনুঘটকটি হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগ। সরকারি বিনিয়োগ দিন দিন বাড়ছে। বিগত অর্থবছরে এটা জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ ছিল। কিন্তু উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, সরকারি বিনিয়োগ যে হারে বাড়ছে, সে হারে দেশের বিনিয়োগকারী তথা বেসরকারি উদ্যোক্তারা প্রস্তুত অবকাঠামো পাচ্ছেন না। সড়ক, রেল, বন্দর ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশাল বিশাল বিনিয়োগ হয়েছে। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগের প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করা, যাতে এর সুফল মানুষ পেতে পারে, যাতে বেসরকারি খাত সুবিধা নিতে পারে, বিনিয়োগে আগ্রহী হয় এবং এর মধ্য দিয়ে যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
কালের কণ্ঠ : আমদানির তুলনায় রপ্তানি বাড়েনি। রেমিট্যান্সের পতন হচ্ছে। চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ অবস্থায় বাজেটে কী উদ্যোগ থাকতে পারে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: তুলনামূলকভাবে রপ্তানি কম হয়েছে কথাটি সত্য হলেও এই সময়ে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়। রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দেশে অত্যধিক পরিমাণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আমদানি বেশি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এমন নয় যে আমরা অনেক বেশি আমদানি করছি। আসলে পেট্রোলিয়াম বা ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে আমাদের অনেক বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এ কারণেই আমদানির সঙ্গে রপ্তানির ফারাক বেশি মনে হচ্ছে। অতিরিক্ত আমদানি ব্যয়ের কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখা এবং ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা বাড়ানো। এ ছাড়া বৈদেশিক উৎস থেকে সরকারের যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, এগুলো কোনো কারণে বিলম্ব না করে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি মার্জিন বাড়িয়ে বিলাসদ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহ করছে—এটা ভালো দিক। এর পাশাপাশি বাজেটের ভেতর থেকেও কর কাঠামোকে ব্যবহার করে বিলাসদ্রব্য আমদানিতে রাশ টেনে ধরা যাবে।
কালের কণ্ঠ: গত বাজেটে গার্হস্থ্য ব্যবহারের ইলেকট্রনিকস উৎপাদনকারী, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ও মোটরযান প্রস্তুতকারীদের যে সুবিধা দেওয়া হয়, এগুলো সার্বিকভাবে দেশি শিল্পকে কি নতুন গতি দিতে পেরেছে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: সরকারের করনীতির একটি উল্লেখযোগ্য উপকারভোগী আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দেশে ধীরে ধীরে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প গড়ে উঠছে। এর ফলে আমরা দেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি উদ্যোক্তাদেরও বিনিয়োগ করতে দেখছি। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে দেখছি। ফলে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে রপ্তানি বেড়ে এক বিলিয়ন অতিক্রম করেছে ২০২১ অর্থবছরে। মোটরযানের ক্ষেত্রে অন্তত মোটরসাইকেল উৎপাদনে আমরা বড় সুফল দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশে কৃষিতে যেভাবে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, তাতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের তেমন বিকল্প নেই। তাই কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।