Originally posted in বণিকবার্তা on 20 November 2023
সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বর্তমানে একজন বয়স্ক ব্যক্তি প্রতি মাসে ৬০০ টাকা ভাতা পান। একজন বিধবা ও নিগৃহীতা নারী পাচ্ছেন ৫৫০ টাকা। তবে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির প্রভাবে যৎসামান্য এ ভাতায় এসব জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদার সামান্যই পূরণ হয়। ভাতার অর্থে বয়স্ক ও বিধবারা বর্তমানে মাসে সর্বোচ্চ ১১ কেজি চাল বা আলু কিনতে পারেন।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আশির দশকে বিভিন্ন ভাতা চালু করেছিল সরকার। মূলত সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সুসংহত করার মাধ্যমে জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নই ছিল এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এর আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা দিচ্ছে সরকার। প্রতি বছর এসব ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে জনপ্রতি টাকার অংকে এ আর্থিক সহায়তার পরিমাণ খুবই কম। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীতে রয়েছে বয়স্ক, বিধবা ও নিগৃহীতা নারী এবং প্রতিবন্ধীরা। এ তিন শ্রেণীর ভাতাভোগীর সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখ ৭৬ হাজার। বর্তমানে ভাতাপ্রাপ্তদের মধ্যে বয়স্করা প্রতি মাসে ৬০০ টাকা, বিধবারা ৫৫০ এবং প্রতিবন্ধীরা পাচ্ছেন ৮৫০ টাকা। এ অর্থে এসব জনগোষ্ঠীর মাসিক চাহিদার কতটুকু পূরণ হয় সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার ওপর ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে ভাতার অর্থের মূল্য আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, গতকাল ঢাকার বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৫০-৫২ টাকা। কেজিপ্রতি আলুর দাম ছিল ৪৫-৫০ টাকা। আর এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৭৩০-৭৫০ টাকা। ফলে ৬০০ বা ৫৫০ টাকা মাসিক ভাতায় একজন বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা বিধবার পক্ষে এক মাসে ১১ কেজি মোটা চাল কিংবা আলু কেনা সম্ভব। তবে তারা চাইলেও এ টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারবেন না।
খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্য ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগের ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্য ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম, কিছু ক্ষেত্রে উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতার হার পরিবর্তন করা হয়েছে।
সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আশির দশক থেকে সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে অর্থ ব্যয় করছে। প্রাথমিকভাবে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মসূচিটি শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে এটি প্রকৃতপক্ষে বাড়েনি। তাছাড়া প্রকৃত উপকারভোগী বাছাই ও বিতরণ পর্যায়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে না পারার কারণেও এর পুরোপুরি সুফলতা পাওয়া যায়নি। বাজেটের অনুপাতে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি। তাছাড়া সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের অর্থও সামাজিক সুরক্ষার আওতাভুক্ত করে আকার বাড়ানো হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার অর্থ বর্তমানে মানুষ অলস বসে ব্যয় করছে। এটিকে যদি কোনোভাবে কর্মক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে প্রণোদনা হিসেবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে সেটি বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’
বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে ভাতার কার্যক্রম চালু করা হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৪ হাজার ২০৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়িয়ে ৫৮ লাখ ১ হাজার জন এবং মাসিক ভাতার হার ৫০০ থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬০০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
বিধবা ও স্বামী কর্তৃক নিগৃহীতা দুস্থ নারীদের সহায়তার জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১ হাজার ৭১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যেখানে এর আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়িয়ে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার জন এবং মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০০ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধীদের প্রতি সরকারের সাংবিধানিক ও আইনগত প্রতিশ্রুতি পূরণ, অসচ্ছল, দুস্থ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ ভাতা বাবদ ২ হাজার ৯৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। যেখানে আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪২৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ৩৫ হাজার বাড়িয়ে ২৯ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। তবে মাসিক ভাতার পরিমাণ ৮৫০ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এ শ্রেণীর মানুষের জন্য ভাতার পরিমাণ ছিল ৭৫০ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০০ টাকা বাড়িয়ে তা ৮৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়।
গত পাঁচ বছরে ভাতার পরিমাণ যে হারে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আর সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ২০১২ সালের পর সর্বোচ্চ। এ সময়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতার সঙ্গে তুলনা করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাভোগীদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে দুর্বলতার কারণে সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রয়োজন অনুসারে ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এসব ভাতার একটি বড় অংশ চলে যায় খাদ্যের পেছনে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, ভাতাভোগীদের ক্রয়ক্ষমতার উন্নতি হয়নি, আগের মতোই আছে। বরং কিছু ক্ষেত্রে ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয়েছে। মূল সমস্যা হচ্ছে সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ সেভাবে বাড়াতে পারেনি। এর ফলে সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে পরিমাণ ব্যয় করার কথা, সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেটির একটি অংশ দিয়ে এসব জনগোষ্ঠীকে সহায়তাও আমরা দিতে পারছি না। সবদিক থেকেই সমাজের এ পিছিয়ে পড়া মানুষদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সম্পদ আহরণের যে দুর্বলতা তার কারণে সম্পদ বণ্টনেও অন্যায্যতা থেকে যাচ্ছে। কর খেলাপি সংস্কৃতি দূর করার মাধ্যমে সম্পদ আহরণের পরিমাণ বাড়িয়ে আমরা যদি সরকারে ব্যয় সক্ষমতা বাড়াতে পারি, তাহলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো যাবে।’
গত পাঁচ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবমূল্যায়ন হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাইতে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। আর সর্বশেষ গতকাল ডলারের বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১১১ টাকায়। সে হিসাবে এ সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এর মধ্যে গত দেড় বছরে ২৯ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষার ভাতাকে জীবনযাপনের একমাত্র আয়ের উৎস কিংবা অবলম্বন হিসেবে মনে করছে না সরকার। বরং এটিকে সহায়তা কিংবা প্রণোদনা হিসেবেই বিবেচনা করতে চান সংশ্লিষ্টরা। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের অভিঘাত মোকাবেলায় কিছুটা সহায়তা করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একসময় তো কিছুই ছিল না, সে তুলনায় আমরা কিছু হলেও দিচ্ছি, এটা তো স্বীকার করতেই হবে। বাজারের তুলনায় কিংবা সার্বিক বিবেচনায় বা মাথাপিছু গড় আয়ের তুলনায় এটি অবশ্যই কম, তা অস্বীকার করব না। এটি কোনো ক্ষতিপূরণ নয়, এটিকে সহায়তা কিংবা প্রণোদনা বলা যেতে পারে। তবে কখনই এটিকে অবলম্বন মনে করা উচিত নয়। জনপ্রতি ভাতার পরিমাণ আরো বেশি হলে অবশ্যই আমি খুশি হতাম। এরই মধ্যে সরকার ভাতার পরিমাণ বাড়িয়েছে, সামনে তা আরো বাড়ানো হবে।’