Published in Prothom Alo on 2 October 2014.
স্মারক বক্তৃতা
রাজনীতিক ও সুশীল সমাজ প্রতিপক্ষ নয়
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
তিনটি দুর্বলতা: তাহলে সুশীল সমাজ এবং এর অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলোর মূল দুর্বলতা কোথায়? যেহেতু এই সমাজ বৈচিত্র্যময়, সেহেতু এসব সংগঠনের সমস্যাগুলোও বিভিন্ন। তবু আমার বক্তব্যের শেষে তিনটি নির্বাচিত অভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করছি।
ক. সুশীল সমাজের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থানকে সংহত করা। যেহেতু চলমান রাজনীতি আমাদের সমাজকে গভীরভাবে দ্বিখণ্ডিত করেছে, সেহেতু বিশ্বাসযোগ্যভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা কঠিনতর হয়ে উঠছে। পেশাদারত্বের সঙ্গে কর্ম সম্পাদন দুরূহ হয়ে উঠছে। উল্লেখ্য, সুশীল সমাজের নেতারাও অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চবর্গের মানুষ হয়ে থাকেন। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা কোনো ঝুঁকি নিতে উৎসাহী হন না। কেউ কেউ হয়তো এটা তাঁদের যথোপযুক্ত নাগরিক সাহসিকতার অভাব বলে অভিহিত করবেন।
খ. সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর একটি বড় অংশে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ভঙ্গের ঘটনা ঘটে, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, যদিও দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে একটি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার পরও অনেক গ্রামীণ এনজিও প্রকৃতপক্ষে শোষণমূলক সুদের ব্যবসায় নিয়োজিত। তবে এদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করপোরেট এনজিওগুলোকে এক করে দেখা ঠিক হবে না।
গ. সুশীল সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। নেতৃত্বের হস্তান্তর ঘটে না। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ-প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়, প্রতিষ্ঠানের টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ে। নেতৃত্বের উত্তরাধিকার সৃষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিকাঠামো শক্তিশালী করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা দরকার।
সমাপনী মন্তব্য
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ তার দীর্ঘ পথ চলায়, সিঁড়ি ভাঙায় আজ এক বিশেষ মুহূর্তে উপনীত হয়েছে। রাজনৈতিক সমাজ ও সুশীল সমাজের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থার সম্পর্কটি এই মুহূর্তে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ভঙ্গুর। সম্প্রতি ঘোষিত সম্প্রচার নীতিমালা এই আস্থার ভিতকে আরও একটু দুর্বল করে দিয়েছে।
স্বাধীনতা–পূর্বকালের স্বাধিকার আন্দোলনে, প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে, স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গড়ার উদ্যোগে এবং দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ প্রায়ই রাজনৈতিক সমাজের সঙ্গে পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। লক্ষণীয়, গত দুই দশকে গণতন্ত্রের নবযাত্রায়, এই সম্পর্ক পরিপূরকতা থেকে ক্রমান্বয়ে প্রতিযোগিতামূলক এবং অনেক সময় বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলে রাজনৈতিক সমাজ সর্বদাই অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার সুশীল সমাজকে পাশে পেতে চায়। আর রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করলে সেই রাজনৈতিক গোষ্ঠীই জবাবদিহির দাবির মুখে সুশীল সমাজকে প্রতিপক্ষ মনে করছে। কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সুশীল সমাজের সঙ্গে এই বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক আরও প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে।
গ্রামসীয় বা নব্য টকভেলীয়—যে ব্যাখ্যাকাঠামোই প্রয়োগ করি না কেন, তাতে দেখা যায়, জাতীয় অগ্রগতির ধারাকে ধাবমান রাখার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি সহায়ক নয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত—এটি একটি স্বীকৃত সত্য। এর বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব যখন সুশীল সমাজকে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে অপারগ করে, তখন রাজনৈতিক সমাজ তার আলোকিত আত্মস্বার্থ রক্ষায় পর্যুদস্ত হয়। তখন সমাজে, অর্থনীতিতে ও বৈদেশিক সম্পর্কে যে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা দেখা দেয়, তা শান্তিপূর্ণ ও ফলপ্রসূভাবে নিরসনের কোনো জায়গা থাকে না। সৃষ্টি হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। বিপর্যস্ত হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের যৌথ লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমাজ ও সুশীল সমাজের মধ্যে উদার ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রীয় মনোভঙ্গির বাতাবরণে একটি আস্থা প্রবর্ধক নীতি-সংলাপ দেশে আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। শহীদ স্মৃতির প্রতি আবারও শ্রদ্ধা জানিয়ে আশা করব, সংশ্লিষ্ট পক্ষরা চিন্তার আদান-প্রদানের এই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আন্তরিকতা ও পরিপক্বতা প্রদর্শন করবে। (শেষ)
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত শহীদ বুদ্বিজীবী স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত।)
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।