Originally posted in সমকাল on 26 March 2021
স্বাধীনতা দিবস ২০২১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীতে সত্তরের দশকে প্রকাশিত একটি বইয়ের শিরোনাম ছিল- Bangladesh : The Test Case for Development’ লেখকরা বইটির ভূমিকায় বলেছিলেন, তারা বইটির শিরোনাম A Test Case না দিয়ে The Test Case দিয়েছেন মূলত এ কারণে যে, তারা মনে করেছেন যদি বাংলাদেশের মতো একটি দেশে উন্নয়ন সম্ভব হয়, তা হলে পৃথিবীর যে কোনো অনুন্নত দেশেই উন্নয়ন সম্ভব হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকের উন্নয়ন অভিজ্ঞতার নিরিখে এ কথা বলার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে যে, উল্লিখিত প্রকাশনার আশঙ্কা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ বিগত সময়ে উল্লেখযোগ্য ও ব্যতিক্রমী অর্জন করেছে, চিরন্তন সাহায্য-নির্ভর একটি দেশ থেকে বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটেছে বাণিজ্য-নির্ভর একটি দেশে। ধারাবাহিক নীতি-সহায়তা ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শ্রম ও উদ্যোক্তা শক্তির কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সময়রেখা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে। এ উত্তরণ অবশ্যই বাংলাদেশের উন্নয়ন আলেখ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ বছরে। এটি আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অর্জনের যেমন একটি প্রতিফলন, তেমনি সে অর্জনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও বটে।
বাংলাদেশের এ ইতিবাচক অর্জন ও ব্র্যান্ডিংকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্ব পরিসরে দেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার একটি সুযোগ হিসেবে এ উত্তরণকে দেখতে হবে। এর ফলে ক্রেডিট রেটিংয়ের মানে উন্নতি, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ও আস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে আশা করা যায়। অন্যদিকে, অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশের অনুরূপ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন- এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের মাধ্যমে রূপকল্প ২০৪১-এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি মাইলফলক হিসেবেও এ অর্জনকে দেখা যেতে পারে।
তবে এ উত্তরণ টেকসই করতে হলে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আগামী পাঁচ বছরের অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। যেহেতু অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতির এ অন্তর্বতী সময় অনেকটাই যুগপৎ, সেহেতু পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও প্রস্তুতি কৌশলের মধ্যে পরিপূরকতা ও সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
উত্তরণ কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন হবে উত্তরণের অভিঘাত যেসব ক্ষেত্রে পড়বে তা নির্ধারণ করা। এটা মূলত হবে চারটি ক্ষেত্রে- বাজার সুবিধা প্রাপ্তি; বৈদেশিক সহায়তা ও বাণিজ্য সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক; নীতি প্রণয়ন স্বাধীনতা; নীতি-মান্যতার বাধ্যবাধকতা। স্বল্পোন্নত গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশ অনেক আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রমের প্রাপ্যতা হারাবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রথমে নির্ধারণ করতে হবে খাতভিত্তিক কী ও কোন ধরনের অভিঘাত স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের কারণে অর্থনীতিতে পড়বে। রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত (শুল্ক্কমুক্ত প্রবেশাধিকার), কৃষি ও শিল্প খাত (বাজার প্রবেশ, ভর্তুকি ও প্রণোদনা), ফার্মাসিউটিক্যালস (মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ) ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে অভিঘাত হবে বিভিন্ন, তার তাৎপর্য ও গভীরতার মধ্যেও ভিন্নতা থাকবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে আরও বাড়তি তিন বছর শুল্ক্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যাবে; মার্কিন বাজারে বর্তমান রপ্তানি কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে তেমন পরিবর্তন হবে না। আবার জাপান ও কানাডাসহ উন্নত এবং ভারত ও চীনসহ উন্নয়নশীল দেশের আঞ্চলিক বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে।
দ্বিতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ যে তিনটি সূচকের মাধ্যমে করা হয় (মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানব সম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক), সেসব সূচকের পরিমাপ করা হয় গড় মান নিয়ে। তাতে বণ্টনের ন্যায্যতা বা গড়ের আড়ালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য ধরা পড়ে না। এসব সূচকে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ও জনগণের জীবনমানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু সেগুলোর ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর অর্জনকে চলমান প্রচেষ্টা হিসেবে দেখতে হবে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে, অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন আরও বেগবান হবে ও টেকসই উত্তরণের অভীষ্টের দিকে আরও সক্ষমতাসহ অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, চলমান কভিড অতিমারির নেতিবাচক অভিঘাত প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, জীবনমানের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের অন্তর্বর্তী সময়ে সেগুলোর মোকাবিলা বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ যোগ করেছে। অর্থনীতির অনেক সূচকের মান, রপ্তানি, আমদানি, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবহার, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ইত্যাদি কভিড-পূর্ব অবস্থান থেকে হ্রাস পেয়েছে। সেসব সূচককে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে হলে ও পূর্বের প্রবৃদ্ধির প্রবণতায় যেতে হলে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম ও উদ্যোগের প্রয়োজন হবে।
২০১৫ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের কারণে ঋণের শর্ত ইতোমধ্যে আরও কঠিন হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে জোর দিতে হবে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বৃদ্ধির ওপর।
প্রস্তুতি-কৌশল বাস্তবায়নে দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক- তিন পর্যায়েই উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন হবে। মূল করণীয় হবে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া আন্তর্জাতিক সহায়তা চলে গেলে আমরা যেন প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে না পড়ি, তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ এবং এ লক্ষ্যে বাজার সুবিধা-নির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে উৎপাদনশীলতা-নির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতায়। পুঁজি ও শ্রমের দক্ষতা, গুণ-মানসম্পন্ন উৎপাদন ব্যবস্থা, উৎপাদনশীলতা, পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণ, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, শ্রম অধিকার শক্তিশালীকরণ- এসব অনুঘটকের ওপর নির্ভর করেই এ উত্তরণ ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য-বিনিয়োগ-যোগাযোগের ত্রিমাত্রিক কার্যকর সংশ্নেষ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধাগুলোকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় রূপান্তর করতে হবে।
একপক্ষীয় প্রাপ্যতা থেকে বাংলাদেশকে উত্তরণ করতে হবে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কে যেখানে বিনিয়োগ-বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর কাছ থেকে দাবি আসবে, সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকেও ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
উন্নয়নশীল সহযোগী হিসেবে প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশ যেন তার নিজস্ব বাজার আরও উন্মুক্ত করে, বাণিজ্য নীতিকে আরও উদার করে, বিদ্যমান সংরক্ষণমূলক নীতিমালায় পরিবর্তন আনে। সুবিধাপ্রাপ্তির অনেকটাই নির্ভর করবে আমরা নিজেরা কতটুকু ছাড় দিতে প্রস্তুত তার ওপর।
স্বল্পোন্নত-বহির্ভূত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আগামীর যাত্রার প্রস্তুতি পর্বে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বাজারের সুযোগ গ্রহণ এবং বর্তমানে যেসব উদ্যোগ এসব ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে, তাকে আরও সমন্বিত ও শক্তিশালী করার প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ভিত্তিতে সমন্বিত অর্থনৈতিক পার্টনারশিপ চুক্তি করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এসব চুক্তি করতে হবে চাহিদা ও ছাড়ের সমন্বয়ে এবং সে লক্ষ্যে তথ্য ও বিশ্নেষণের ভিত্তিতে ‘অনুরোধ’ ও ‘অর্পণ’ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ‘ডব্লিউটিও সেল’-এর মতো একটি ‘নেগোসিয়েশন সেল’ খোলার এবং সেটিকে যথাযথভাবে জনবল, অর্থবল ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ও প্রস্তুত করার এখনই উপযুক্ত সময়।
তিনটি পরিচয়কে ধারণ করে অন্তর্বর্তী এ সময়ে বাংলাদেশকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় অংশগ্রহণ করতে হবে স্বল্পোন্নত দেশ, উত্তরণকালীন দেশ ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নকালীন দেশ। অন্য দেশগুলোর কাছ থেকে ২০২৬ সালের পরেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুরূপ বাজার সুবিধা প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কানাডা ও জাপানের মতো বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এলডিসি স্কিমের মাধ্যমে ভারত ও চীন যে বাজার সুবিধা দিয়ে থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও বাড়তি সময়ের জন্য বাজার সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উত্তরণের পরবর্তী সময়ে (অতিরিক্ত ১২ বছরের জন্য) বাজার সুবিধা প্রদানের যে প্রস্তাব আনা হয়েছে এবং যে প্রস্তাবের পেছনে বাংলাদেশের জোরালো সমর্থন ছিল, তার পক্ষেও বাংলাদেশকে সক্রিয় থাকতে হবে, যেমন করে সক্রিয় থাকতে হবে মেধাসত্ত্ব আইনসহ অন্যান্য বিধানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে উত্তরণ পরবর্তীকালেও বাড়তি সময় প্রদানের দাবিতে। একই সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশকে এখন অংশগ্রহণ করতে হবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভবিষ্যৎ স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে। বিশেষত নভেম্বর ২০২১ সালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠককে সামনে রেখে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে, যেখানে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ ও ভবিষ্যতের উন্নয়নশীল দেশ- এ দ্বৈত ভূমিকায় বাংলাদেশকে অংশগ্রহণ করতে হবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ বছরে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট সময়রেখা নির্ধারণ বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ও আত্মমর্যাদার গৌরবে সিক্ত একটি মাইলফলক। একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের আগামীর যাত্রায় এ আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা আরও নতুন নতুন মাইলফলক অর্জনের শক্তিমত্তা ও সম্ভাবনার কথাই বলে। সুশাসন শক্তিশালী করা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা বিধানই হবে বাংলাদেশের সামনে নতুন প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ। এসডিজি ও রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে টেকসই উত্তরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ চ্যালেঞ্জগুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমেই এসব লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)