Published in শেয়ার বিজ on Monday, 26 March 2018
রাজস্ব ১৬৬ কোটি থেকে দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে
স্বাধীনতার ৪৭ বছর
মাসুম বিল্লাহ
বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে আসেনি। কিন্তু তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা নিয়ে যাত্রা করা দেশটির রাজস্ব বাজেটের প্রায় পুরো ব্যয় মেটানো হয় দেশীয় অর্থায়নে। উন্নয়ন বাজেটেরও সিংহভাগ অর্থ জোগান আসে দেশীয় অর্থ থেকে। আর বৈদেশিক উৎস থেকে উন্নয়ন কাজে যে অর্থ আসে, তার প্রায় পুরোটাই ঋণ হিসেবে। অথচ একসময় বিদেশি অনুদান ছাড়া বাজেট করা কষ্টকর হয়ে যেত। এ কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর বাইরে এনবিআরবহির্ভূত উৎস থেকে কিছু রাজস্ব আসে। দেশ স্বাধীনের পর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি টাকা। বর্তমানে তা দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে উন্নীত হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২-৭৩ সালে সংস্থার রাজস্ব আহরণ হয়েছিল মাত্র ১৬৬ কোটি টাকা। আর বাইরে ভূমি নিবন্ধন, বন বিভাগ, ডাক বিভাগসহ অন্যান্য উৎস থেকে আরও প্রায় ১০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ হয়েছিল। ওই সময় কর-জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র সাড়ে তিন শতাংশের মতো। আর অর্থবছরটিতে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। কাজেই বাজেটের সিংহভাগের জোগান নিশ্চিত করতে দ্বারস্থ হতে হয়েছিল বহির্বিশ্বের।
অর্থনৈতিক এ টানাপড়েন চলতে থাকে পরবর্তী ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এমনকি ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরেও আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল পাঁচ শতাংশের নিচে। অর্থবছরটিতে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ হয়েছিল তিন হাজার ৫৪ কোটি টাকা। আর অর্থবছরটিতে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল সাত হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। বাকি অর্থের জোগান নিশ্চিত করা লাগত বিদেশি সাহায্য ও ঋণের মাধ্যমে। আর বর্তমানে রাজস্ব আহরণ দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে উন্নীত হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী এনবিআর থেকে রাজস্ব আহরণ হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকে এসেছে আরও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে আহরণ দুই লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মতো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম শেয়ার বিজকে বলেন, স্বাধীনতার পর একটি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে বর্তমান পর্যায় পর্যন্ত আসা অবশ্যই একটি বড় অর্জন। সে সময়ে আমাদের বাজেট ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশের মতো নির্ভর করত বৈদেশিক নানা উৎসের ওপর। আর এখন প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থের জোগান হয় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। সে বিবেচনায় অর্জন কম নয়।
তবে আগামী দিনে অনেকগুলো লক্ষ্য আমাদের অর্জন করতে হবে। আর সেটা করতে হলে রাজস্ব আহরণ আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এসডিজির অভীষ্ট অর্জন, এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজস্ব আহরণ আরও বাড়াতে হবে। সে সম্ভাবনাও আমাদের অর্থনীতিতে আছে। সেটা কাজে লাগাতে হলে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, কর কাঠামোয় সংস্কারসহ বিভিন্ন ধরনের নীতির সঠিক প্রয়োগ, সর্বোপরি সুশাসনের ওপর জোর দিতে হবে।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় অর্থবছর ১৯৭৩-৭৪ সময়ে মোট রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ২৭৮ কোটি টাকা। ওই বছর বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল ৯৯৫ কোটি টাকা। প্রথমবারের মতো এনবিআরের রাজস্ব আহরণ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে। বছরটিতে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল এক হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। এরপর রাজস্ব আহরণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে। সে সময় আহরণ হয়েছিল পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো। এরপর থেকেই রাজস্ব আহরণ দ্রুত বাড়তে থাকে। পাঁচ বছরের মধ্যে রাজস্ব আহরণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ ধারা পরবর্তী সময়ে অব্যাহত থাকতে দেখা যায়। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ১০ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। এর ছয় বছর পর ২০০১-০২ অর্থবছরে যা বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংস্থাটির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ লক্ষ্য সংশোধন করা হবে।
সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অর্থ বিভাগের হিসাবে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ ছিল এক লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। যদিও এনবিআরের হিসাবে তা এক লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছর যা ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আহরণ ছিল এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছর যার পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ অনেক কম। বর্তমানে এ অনুপাত ১১ শতাংশের মতো। আর বাজেট ঘোষণা করা হয় ১৬ থেকে ১৭ শতাংশের মতো। সে হিসাবে প্রতিবছর জিডিপির পাঁচ শতাংশের মতো ঘাটতি প্রাক্কলন করে বাজেট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সরকারি নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ও নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করায় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, অব্যাহতির সংস্কৃতি চালু রাখা একদম ঠিক নয়। অগ্রাধিকার বিবেচনায় বিভিন্ন প্রকল্পে কর ছাড় দেওয়া হয়। এটা কাম্য হতে পারে না। যেসব অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত রয়েছে, সেগুলোকে প্রয়োজনে ভর্তুকি বা বিনাসুদে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অব্যাহতি দেওয়া হলে তা সরকারের হিসাবের বাইরে চলে যায়। তাই সব ক্ষেত্রেই কর বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে স্বচ্ছতা বাড়বে। আর স্বচ্ছতা বাড়লেই অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র ও রাজস্ব আহরণের প্রকৃত সম্ভাবনা জানা যাবে।