বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা খাদ্য মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বড় কারণ – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in দৈনিক ইনকিলাব on 15 September 2023

সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না ডিম-আলু-পেঁয়াজ

সরকারকে তোয়াক্কা করছে না সিণ্ডিকেট

বিশ্ববাজারে সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম তো কমেইনি, উল্টে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। যার প্রভাবের মধ্যেও ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা, আলুর কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং পেঁয়াজের দাম ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সরকারের এই দাম নির্ধারণের একদিন পর সাপ্তাহিক ছুটির দিন গতকাল বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। নতুন দামের নির্দেশনা ব্যবসায়ীরা পেলেও, মানছে না কেউই। আর তাই দ্রব্যমূল্যের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে ভোক্তা। অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, বাজারে বেঁধে দেয়া তিন পণ্যের দাম শক্তভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। এটি দেশে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির এই বিষয়টি শুধু আগস্ট মাসের বিষয় নয়, বরং গত বছরের মার্চ থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তা আর ঠেকানো যায়নি এবং সেটাই এখন এতো বড় আকার ধারণ করেছে। তারা বলছেন, সরকারের ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপ এবং সেই সাথে বাজারের উপর কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যায়নি। আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো ২০২২ সালে দেশে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো এ বছরের আগস্টে সেই একই পণ্য কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১১২ টাকা ৫৪ পয়সা। অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এর তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে সারা বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে সর্বনিম্ন হয়েছে। এই সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। এর আগে দেশে পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টিকে ব্যবহার করা হলেও এখন সেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলেও তার প্রতিফলন কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না।

গতকাল সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার একাধিক বাজার ঘুরে খাদ্যপণ্যের দাম কমা বা নির্ধারিত মূল্য দূরের কথা উল্টো বাড়ার চিত্র দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের নির্ধারণ করা দামে আমরা কিনেও আনতে পারিনি, তাহলে ওই দামে বিক্রি করবো কী করে?

মধ্যবাড্ডা কাঁচাবাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, যথারীতি আলু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা করে, যেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা করে। এছাড়াও ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা করে, যেখানে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। এছাড়াও ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি হালি ৫৫ টাকা করে, যেখানে সরকারি নির্ধারিত দাম ৪৮ টাকা।

আলুর দাম প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী আফজাল বলেন, আলু বর্তমানে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা পাইকারি দরেই কিনে আনতে হয়েছে। ৪৪-৪৫ টাকার নিচে কিনতে পারাই কঠিন, তাহলে সরকার নির্ধারিত ৩৫ টাকা করে বিক্রি করবো কী করে? আমরা কি লস দিয়ে বিক্রি করবো? আমরা যদি কমে কিনতে পারি তাহলে অবশ্যই কমে বিক্রি করবো। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের তালিকা এখনও আমাদের কাছে আসেনি। আমরা যদি ওই দামে কিনতে পারি তাহলে তো বেশি দামি বিক্রি করার কোনো মানে হয় না। দাম কম থাকলে বরং বিক্রি আরও বেশি হয়।
অন্যান্য দ্রব্যের দাম প্রসঙ্গে আফজাল বলেন, বাজারে বেগুন এক কেজি ১০০ টাকা, করলার কেজি ৬০, পটল ৪০, ঢেঁড়স ৪০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও শসা কেজি ৫০ টাকা, ফুলকপি পিস ৩০ টাকা, বাঁধাকপি পিস ৩০ টাকা। বাজারের দামটা মোটামুটি স্বাভাবিকই বলা যায়। তবে শুধুমাত্র বেগুনের দামটা বেড়েছে। ৬০ টাকা ৭০ টাকা ছিল সেটি এখন ১০০ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে।

সরকার নির্ধারিত দাম প্রসঙ্গে আপনারা অবগত কি না? জানতে চাইলে আব্দুস সালাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই অবগত। বিষয় হলো সরকার নির্ধারিত এই দাম আমাদের কাছে আসতে সময় লাগবে অন্তত এক সপ্তাহ। সরকার নির্ধারিত যে পেঁয়াজের দাম, সে দামে আমরা আজকে কিনেও আনতে পারিনি। তাহলে কীভাবে সেই দামে বিক্রি করবো? ‘আলুর যে সিন্ডিকেট, ভোক্তা পর্যায়ে আসার আগেই দামের পাঁচটি স্তর রয়েছে। ৩০ টাকার আলু যদি এই পাঁচটি স্তরে ২ টাকা করেও লাভ করা হয়, তারপরও ১০ টাকা বেশি দামে আমাদের বিক্রি করতে হবে।’

কোনো কিছুর দাম বাড়লে খুচরা বাজারে সঙ্গে সঙ্গেই দাম বেড়ে যায়, দাম কমার ক্ষেত্রে তাহলে কেন ধীরগতি? -এবিষয়ে জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, আমাদের খুচরা বাজারে যে কোনো পণ্যের দাম আড়তের সঙ্গে মিলিয়ে বিক্রি করতে হয়। আড়ৎ যদি রাতারাতি দাম কমিয়ে দেয়, তাহলে আমরাও কমে বিক্রি করতে পারি। আবার আরও যদি রাতারাতি দাম বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমাদেরও বেশি দামেই বিক্রি করতে হবে। দামটা আসলে সরাসরি আড়তের সঙ্গে নির্ধারিত।

কাপ্তান বাজারের ডিম বিক্রেতা জামাল হোসেন বলেন, ডিম প্রতি ডজন বিক্রি করছি ১৫৫ টাকা করে, হালিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা করে। সরকারের নতুন দাম নির্ধারণ বিষয়ে কিছুই জানি না। আমরা যদি কমদামে কিনে আনতে পারি, তাহলে কম দামে বিক্রি করতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে খুচরা বাজারে তদারকি করার আগে পাইকারি বাজার এবং আড়তগুলোতে কী দামে বিক্রি হচ্ছে, সেটি আপনাদের দেখা উচিত।

সেগুনবাগিচা বাজারে কথা হয় ক্রেতা রমজান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, শুনেছি সরকার আলু পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাজারে এসে তার কোনো প্রতিফলন দেখছি না। যেখানে আলু বিক্রি করতে বলা হয়েছে ৩৫ টাকা করে, সেখানে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি। এখনও দামের কতটুকু পার্থক্য ভাবাই যায় না। যদি দাম না কমিয়ে উল্টো বাড়ানো হতো, তাহলে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তি দামে বিক্রি শুরু হয়ে যেত। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের চরিত্রটাই এমন হয়ে গেছে।

ডিম বিক্রেতা জামাল বলেন, বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ কারও নির্দেশনা মানে না। যে যেভাবে পারছে দাম বাড়াচ্ছে, আর বিক্রি করছে। মানুষ তাদের কাছে অনেকটাই জিম্মি।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। মানুষের আয়-ইনকাম কমে গেছে। অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে ঘুরছে। এই অবস্থায় বাজার যদি এমন উর্ধ্বমুখী হয়, তাহলে আমরা বাজার করবো কী করে? আমাদের সংসার চলবে কী করে?

এদিকে আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় বাজারে চাহিদা ও সরবরাহ সাংঘর্ষিক অবস্থায় আছে এবং সে কারণে মূল্য বাড়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেই মূল্য বাজারে প্রতিফলিত হচ্ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। তার মতে, উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর- এই দুই পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্ত্বভোগী রয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে বাজারটা একচেটিয়াভাবে চলে গেছে। তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেটার কারণে যে মূল্যটা সেটা বাজারের প্রতিযোগিতার সক্ষমতার নিরিখে হচ্ছে না। তিনি বলেন, এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই বাজারের মূল্য নির্ধারণ করছে এবং অনেক সময় সরবরাহকে প্রভাবিত করছে।

সানেম নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ীরা একটা সাময়িক সরবরাহ সঙ্কট তৈরি করে কোন কোন পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ফেলে। যেটার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। চিনি বা ভোজ্য তেলের মতো খাতে সরবরাহকারীর সংখ্যাও হাতেগোনা, মাত্র তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বাজারকে প্রভাবিত করার প্রবণতা আছে বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে বাজারে অ্যান্টি-কমপিটিটিভ প্র্যাক্টিসের (প্রতিযোগিতাহীন অবস্থা) নিদর্শন পাওয়া যায়, অথচ এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোন শক্তিশালী পদক্ষেপ আমরা দেখি না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠান আছে যেমন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার অধিদফতর বা প্রতিযোগিতা কমিশন – এসব প্রতিষ্ঠানের খবরদারিতে দুর্বলতা রয়েছে। আর এ কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, এসব প্রতিষ্ঠানের উচিত বাজারব্যবস্থাকে একটা নজরদারির মধ্যে নিয়ে এসে, মূল্যস্ফীতি অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা।