দুর্ভিক্ষ হবে না, তবে আরও অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in The Daily Star on 7 November 2022

সোমবার দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: করণীয়’ শীর্ষক রাউন্ডটেবিল আলোচনায় অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইসড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ ও অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা এবং বিটপী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিরান আলী। রাউন্ডটেবিলটি সঞ্চালনা করেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা কাটাতে এবং আগামীতে পরিস্থিতি যেন আরও খারাপের দিকে না যায় তার জন্য সরকারকে সমন্বিত ও সুস্পষ্ট কৌশল গ্রহণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

আজ সোমবার দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: করণীয়’ শীর্ষক রাউন্ডটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এ কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইসড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ ও অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা এবং বিটপী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিরান আলী

রাউন্ডটেবিলটি সঞ্চালনা করেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম

অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইসড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার জন্য শুধু বাহ্যিক কারণগুলোই দায়ী নয়। বরং দেশের ভেতরেরই এমন কিছু বিষয়ের কারণে এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। এর মধ্যে রয়েছে কম রাজস্ব আদায়, অনুপযুক্ত খাতে সরকারি ব্যয় এবং অনাদায়ী ঋণ।’

তিনি বলেন, ‘দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যবসায়ী, ব্যাংকার সবারই ভূমিকা রয়েছে।’

‘ভালো দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু খারাপ দিক হচ্ছে, সেই অনুযায়ী রেমিট্যান্স বাড়েনি। এর কারণ হতে পারে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা আসা এবং আসন্ন নির্বাচনের আগে অবৈধ অর্থ লেনদেন’, যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন তার পুরোটা এখনো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। সেটাও আরেকটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় এই সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে সহযোগিতা করেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অস্থিরতার কারণে দেশে খাদ্য, জ্বালানি, ডলারসহ নানা বিষয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, দিন শেষে যার ফলাফল ভালো হবে না।’

‘বর্তমান সমস্যার পাশাপাশি আমাদের কিছু লিগ্যাসি ইস্যু আছে। সব মিলিয়েই আমরা একটি ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি করেছি। প্রথম লিগ্যাসি ইস্যু হচ্ছে, দেশের ৬ বা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পরেও আমাদের কর ও জিডিপির পার্থক্য ৯ শতাংশের নিচে আনতে পারছি না। যার কারণে আমরা পরোক্ষ করের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। সব মিলিয়ে আমাদের খরচের সামর্থ্য কমছে’, যোগ করেন তিনি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা যে ভর্তুকি দেই সেটাকে অর্থনীতিতে ২ ভাগে ভাগ করা হয়, একটি ভালো ভর্তুকি, আরেকটি খারাপ ভর্তুকি। আমাদের ভালো ভর্তুকির চেয়ে খারাপ ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে গেছে। আপনারা বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ বিষয়ে নিশ্চই অবগত আছেন।’

তিনি বলেন, ‘সুদের হার ও মুদ্রা বিনিময় হার আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সঙ্গে সঠিক ডেটা না থাকাও একটি বড় সমস্যা।’

‘আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি খরচ নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখাসহ সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে সমস্যা সমাধানে, এটা ভালো বিষয়। তবে, বিনিময় হারের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল বাণিজ্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন করা যাবে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়’, যোগ করেন তিনি।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে স্বচ্ছতা, প্রণোদনা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ হবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। তবে অনেক বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন এবং এর ফলে অনেক বেশি মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার হবেন। আমি মনে করি দুর্ভিক্ষের আলোচনা আসছে এক্সটার্নাল ন্যারেটিভকে শক্তিশালী করার জন্য। এটা বলার জন্য যে, এটা আমাদের সমস্যা না, বৈশ্বিক সমস্যা। ইউক্রেন থেকে যদি জাহাজ আসতো তাহলে এই সমস্যা থাকতো না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে রিজার্ভ ইস্যু। এখানে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এতগুলো বছর ধরে এ দেশের অর্থনীতিবিদরা যেসব কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেলেন, কিন্তু সরকার সেগুলো শুনলো না, এখন ওয়াশিংটন থেকে লোক এসে সেগুলো মানতে বাধ্য করবে। কাজেই আইএমএফের ঋণের অর্থটাকে টাকার অংকে মূল্যায়ন করাটা ঠিক হবে না। এটাকে দেখতে হবে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা ও সংস্কারের জন্য জমে থাকা নীতিগত ও কাঠামোগত বিষয় সমাধান করার সুযোগ হিসেবে।’

৩-৪ মাস আগেও অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতির বিষয়ে শঙ্কার কথা বলতেন, সরকার বলতো অর্থনীতিবিদরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিন্তু এখন সরকার দুর্ভিক্ষের কথা বলছে, কিন্তু অর্থনীতিবিদরা তা মনে করছেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘৩-৪ মাস আগে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যে কথা বলেছেন এখন তার উল্টোটা কেন বলছেন, এটা নিয়ে তাদেরকে প্রশ্ন করা দরকার। তাদের কাছে জানতে চাওয়া দরকার এই কয়েক মাসের মধ্যে তাদের পলিসি বদলে গেছে কি না। এভাবে তাদের কাছে প্রশ্ন করা হচ্ছে না। তাদেরকে যেহেতু এভাবে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে না, সেই সুযোগে তারা যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছেন।’

মানুষের, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সমস্যার দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। সেদিকে নজর দিতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা খাতের দিকেও নজর দিতে হবে। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় এখন কিছুই হয় না। এটা বাড়াতে হবে। দেশের বর্তমান সমস্যা সমাধানে স্বচ্ছতা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের সমস্যা এতটাই বেশি যে সেখান থেকে উত্তরণে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক উভয়েরই সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। বাজেট সহযোগিতা এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভারসাম্য আনতেই এটা করতে হচ্ছে।’