ব্যাংককে করের টাকা দিয়ে ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করা হচ্ছে – মোস্তাফিজুর রহমান

Published in প্রথম আলো on Saturday 1 June 2019

 

আগামী অর্থবছরের বাজেট, অর্থনীতির নানা দিক ও ব্যাংক খাত নিয়ে গতকাল শুক্রবার সিপিডি কার্যালয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম।

 

প্রথম আলো: ১৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে আসার এই সময়ে বাজেট কেমন হওয়া উচিত বলে সিপিডি মনে করে?

মোস্তাফিজুর রহমান: ১০ বছর পর আমরা নতুন একজন অর্থমন্ত্রীর তৈরি বাজেট দেখতে যাচ্ছি। আমি মনে করি, আগের অর্থবছরগুলোর সঙ্গে আগামী অর্থবছরের একধরনের ধারাবাহিকতা থাকবে। রাতারাতি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রত্যাশা করাটা অযৌক্তিক হবে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে, তার জন্য নতুনভাবে বাজেট করার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ধারাবাহিক অর্জন, যেটা ছিল অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকা, সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, লেনদেনের ভারসাম্য ইতিবাচক থাকা—এগুলো কিছুটা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। আবার, এ বাজেট হবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ অর্থবছরের বাজেট। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজ যেহেতু শুরু হবে, উচিত হবে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ধারার সঙ্গে এর যোগসূত্র রেখেই নতুন বাজেট তৈরি করা।

 

প্রথম আলো: বাংলাদেশ তো অনেক ক্ষেত্রে ভালো করছে। কিন্তু এই ভালো ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে—এই বিবেচনায় টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। তার জন্য বাজেটে কি সুরক্ষামূলক উদ্যোগ থাকা উচিত?

মোস্তাফিজুর রহমান: গড়ে আমরা ভালো করছি। তবে সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বা টেকসই উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ উন্নয়নকে হতে হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব—এই ত্রিমাত্রিক সংশ্লেষে। বণ্টন এবং বৈষম্য নিরসনের দিক থেকে বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটছে সমাজে। ২০২৪ সাল শেষে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে আমাদের যেতে হবে। সুতরাং, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরবরাহ সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি খাতে চাঞ্চল্য আনাই হবে বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

 

প্রথম আলো: বৈষম্য নিরসনে তাহলে কী করা উচিত?

মোস্তাফিজুর রহমান: আয়, ব্যয় ও পুনর্বণ্টন—এ হলো বাজেটের তিনটা দিক। বাজেটে আয় ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনতে হবে। আয়ের ক্ষেত্রে যদি বলি, আমাদের প্রত্যক্ষ কর মোট করের এক–তৃতীয়াংশ। তার মধ্যে ব্যক্তি কর আবার প্রত্যক্ষ করের এক–তৃতীয়াংশ। বিশ্বের অন্য দেশে তা একেবারেই বিপরীত। অথচ বাজেটের মাধ্যমেই অর্থ সংগ্রহ করে সরকার বিনিয়োগ করে। এই যে ঋণখেলাপি, করখেলাপি—এ ব্যাপারে যে আইনগুলো আছে, যথেষ্ট মাত্রায় প্রয়োগ হচ্ছে না। আবার দুর্নীতির কারণেও বৈষম্য বাড়ছে।

 

প্রথম আলো: অর্থ পাচারের কারণে কি বৈষম্য বাড়ছে না?

মোস্তাফিজুর রহমান: হ্যাঁ, বাড়ছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে একটা ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল আছে। একটা বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বছরের পর বছর বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশ থেকে বছরে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তা আমাদের বৈদেশিক আয় ও বিনিয়োগের চেয়েও বেশি। অর্থ পাচার ঠেকাতে হলে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল হয়েছে বটে, এটি যাতে কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে, সে জন্য কোনো বিনিয়োগ কি হয়েছে? হয়নি।

 

প্রথম আলো: বাজেটে অগ্রাধিকার খাত কী হওয়া উচিত? আর–ব্যয়ের বিন্যাস কি এমনই থাকবে?

মোস্তাফিজুর রহমান: ব্যয়ের দিকের সরকারের কর্মকাণ্ড নতুনভাবে বিন্যস্ত করা দরকার। যেমন: শিক্ষা খাতে ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫ শতাংশেরও কম। এটাকে ৪ শতাংশে নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে ১ শতাংশের কম, কমপক্ষে একে দ্বিগুণ করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশের কথা বলা হলেও পেনশন বাদ দিলে তা ১ দশমিক ৭ শতাংশ। আমাদের নীতিমালার মধ্যেও বৈষম্য লুকিয়ে থাকে। এগুলো পরিষ্কার করা উচিত।

 

প্রথম আলো: ব্যাংক খাতের জন্য আপনার নতুন কোনো পরামর্শ আছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: অর্থনীতির জন্য ব্যাংক অত্যন্ত সংবেদনশীল খাত। ব্যক্তি বিনিয়োগ প্রায় স্থবির। সম্প্রতি ঋণখেলাপিদের নিয়ে কিছু উদ্যোগ দেখছি। ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারকারীদের শাস্তি দেওয়ার বদলে উল্টো আরও টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। কোনো কারণে এটা হলে ফল খারাপ হবে। আগেও এক পরিবার থেকে চারজনকে ব্যাংকের পরিচালক এবং তাঁদের টানা ৯ বছর পর্ষদে রাখার বিধান করা হয়, যা কাম্য ছিল না।

 

প্রথম আলো: আপনার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোকে জনগণের করের টাকা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার দায় করদাতাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে আমি বলব ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করা হচ্ছে। সিপিডি আগেই ব্যাংক খাত নিয়ে একটা কমিশন করার কথা বলেছিল। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজিও হয়েছিলেন। তবে সরকারের নিজের স্বার্থেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত, আন্তর্জাতিকভাবে যে বিষয়টিকে বলা হয় ‘আলোকিত স্বার্থপরতা’।

 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।