Originally posted in প্রথম আলো on 4 October 2024
দ্রব্যমূল্য কমাতে নজর কম
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উচ্চ মূল্য মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। তখন সরকার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে উদাসীনতা দেখাত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার নানা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ কম।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় দুই মাসে ছয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। কমেছে মাত্র দুটির।
বাজারে এখন সবজির দাম ব্যাপক চড়া। ডিমের প্রতি ডজনের দর উঠেছে ১৭০ টাকায়। মুরগি ও মাছের দামেও স্বস্তি নেই। সব মিলিয়ে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট কমেনি।
মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে লাগাম তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে একটা জায়গায় স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু সুদের হার ও ডলারের দামের কারণে নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুদের হারে লাগাম তুলে নেওয়ার পদক্ষেপ ঠিকই আছে। তাতে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে। পণ্যের চাহিদা কমবে। মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা কার্যকর নয়। কারণ, সেসব পণ্যের চাহিদা সব সময়ই থাকে। বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর ওই সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।
যেমন ডিম। এর দাম উৎপাদন খরচ, চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। যখন মানুষের হাতে টাকা কম থাকে, তখন বরং ডিমের চাহিদা বেড়ে যায়। ডিমের দাম কমাতে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অব্যাহত উচ্চ মূল্য শহর ও গ্রামের সব মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। তখন সরকার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বরং উদাসীনতা দেখাত। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সংস্কার দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো বড় একটি মন্ত্রণালয় সামলানোর পরে উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যথেষ্ট নজর দেওয়ার সুযোগ কম। এই মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক নানা চ্যালেঞ্জ এখন আছে, সামনে আরও বাড়বে। এখানে এককভাবে দায়িত্ব দিয়ে একজন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, যিনি গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে কাজ করবেন।
দাম বেড়েছে, কমেছে
টিসিবির বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৮ আগস্টের তুলনায় গতকাল বৃহস্পতিবার মোটা চাল কেজিতে ১ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৬ টাকা, পাম তেল ১২ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১০ টাকা, চিনি ৩ টাকা ও ডিম ডজনে ১৫ টাকা বেড়েছে।
বিপরীতে পেঁয়াজ ও আলুর দাম কেজিতে ৫ টাকা কমেছে। এ দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ছিল। শুল্ক কমিয়ে আমদানির ব্যবস্থা করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
টিসিবির তালিকায় আলু ছাড়া অন্য সবজির দাম থাকে না। তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজারদরের তালিকায় বিভিন্ন ধরনের সবজির দর উল্লেখ করা হয়। তাদের হিসাবে, ৮ আগস্টের তুলনায় এখন বেশির ভাগ সবজির দাম বেশি।
যেমন বেগুনের দাম এখন জাতভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা, যা ৮ আগস্ট ছিল ৪০ থেকে ৮০ টাকা। একইভাবে চলতি মৌসুমের সবজি চিচিঙ্গার কেজি ৫০ থেকে ৮০ টাকা, যা মাস দুয়েক আগে ছিল ৩৫ থেকে ৬০ টাকা।
ঢাকার মিরপুর-১১ নম্বর কাঁচাবাজার, কালশী কাঁচাবাজার, তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজারের খুচরা দোকান ঘুরে গতকাল দেখা যায়, বেশির ভাগ সবজির কেজি ৬০ থেকে ১০০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, সবজির সরবরাহ কম। দুই মাসে দাম অনেকটাই বেড়েছে।
মিরপুর-১১ নম্বর কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মনসুর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবজির দর শুনে মানুষ প্রতিদিনই জানতে চায় এত দাম কেন। আমাদের কাছে কোনো জবাব থাকে না। মানুষ আসলেই কষ্টে আছে। আমাদেরও লাভ কমে গেছে।’
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সবজি ছাড়া বাজারে দুই মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ডিম, মুরগি, খোলা ভোজ্যতেল ও চিনির দাম। মাঝারি চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে, যা টিসিবির তালিকায় উল্লেখ নেই।
নিম্ন আয় ও স্বল্প আয়ের পরিবারে প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস ডিম ও ফার্মের মুরগি। ডিমের ডজন এখন ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা, দুই বছর আগেও বছরজুড়ে সাধারণত ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে থাকত। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ২০ টাকা কম ছিল। দুই বছর আগে ক্রেতারা ব্রয়লার মুরগি কিনতে পারতেন সাধারণত ১৩০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে।
কালশী বাজারে মাছের দাম নিয়ে দর-কষাকষি করছিলেন গৃহিণী ঝরনা বেগম। তিনি ছোট আকারের রুই মাছ ৩০০ টাকা কেজি কিনতে চাইছিলেন। কিন্তু বিক্রেতা তোফাজ্জলের কথা, দাম এক টাকাও কম হবে না।
ঝরনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। যে যার মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। ৮০-১০০ টাকার নিচে তরকারি (সবজি) কেনা যায় না। ডিম ও মাছের দামও দিন দিন বাড়ছেই। পুরাই যাচ্ছেতাই অবস্থা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। মার্কিন ডলারের দাম বাড়তে থাকে। এরপরই সব পণ্যের দাম বাড়া শুরু হয়।
চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, মাছ, মাংস, সবজি, মসলাসহ প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং কারখানায় উৎপাদিত নিত্যব্যবহার্য সাবান, টুথপেস্ট, টিস্যু, নারকেল তেল, শিশুখাদ্য, প্রসাধন ইত্যাদির দাম বেড়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়েছে, যা আবার শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার কৌশল নিয়েছিল; কিন্তু তা কাজে আসেনি। এখনো কাজে আসছে না। যেমন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলজিপি) ১২ কেজির সিলিন্ডারের নির্ধারিত দর এখন ১ হাজার ৪৫৬ টাকা। গত বুধবারই এক সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা রওশন আরা। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম ১ হাজার ৭০০ টাকা নিয়েছে।
কী করছে নতুন সরকার
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। ডলারের দাম ১২০ টাকার আশপাশে মোটামুটি স্থির হয়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ১০ শতাংশের কিছুটা কম হয়েছে। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। মানে হলো, গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে খাদ্য কিনতে মানুষকে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো, তা কিনতে এখন ১১০ টাকার বেশি লাগছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ৫০০টির বেশি পণ্য ও সেবার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। তবে স্বল্প আয়ের পরিবারে চাপ পড়ে কিছু নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে। এসব পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি। মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী মানুষের মজুরিও বাড়ছে না। বিবিএস বলছে, সেপ্টেম্বরে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো। মানে হলো, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমেছে।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম কমানোর জন্য পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের শুল্ক কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আবেদন করেছিল। এনবিআর পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ক কমিয়েছে। এ দুটি পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে এর বাইরে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ে কাজ করেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত বৈঠক করছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছে। তবে অনেক সিদ্ধান্তই অন্য মন্ত্রণালয়, বিভাগের আপত্তিতে আটকে যায়। তিনি বলেন, সরকার এখন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিচ্ছে না। ফলে এখন রাজস্ব ছাড় দিয়ে হলেও মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। এ জন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ।
কী করা যায়
দ্রব্যমূল্য কীভাবে কমানো যায়, তা জানতে অর্থনীতিবিদ, বাজার বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়তে দেওয়া সঠিক পদক্ষেপ। তবে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
স্বল্প মেয়াদে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রথমত, চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও ডিমের শুল্ক–কর কমানো। এতে দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হবে এবং সরবরাহ বাড়বে। এক কেজি চিনিতে এখন ৪৪ টাকার মতো শুল্ক–কর আছে। আওয়ামী লীগ সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণের জন্য চিনিসহ কিছু নিত্যপণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক–কর আরোপ করে রেখেছিল।
দ্বিতীয়ত, কাস্টমসে শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডলারের দাম পুনর্বিবেচনা করা। কাস্টমস এখন ১২০ টাকা দরে শুল্ক নির্ধারণ করে, যা গত মাসে ছিল ১১৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্কায়ন মূল্য বা ট্যারিফ ভ্যালু কমিয়ে দেওয়া বা শুল্ক কমানো যেতে পারে।
তৃতীয়ত, ভারত চাল রপ্তানি উন্মুক্ত করেছে। চালের শুল্ক কমালে আমদানির সুযোগ তৈরি হবে। তখন দেশীয় চাল মজুতকারীরা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে দাম কমাতে বাধ্য হবেন।
চতুর্থত, সীমিত সময়ের জন্য হলেও শুল্ক কমিয়ে ডিম আমদানির সুযোগ দেওয়া। পোলট্রি খাদ্যের বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে আমদানি সহজ করা, যাতে দাম কমে খামারিদের উৎপাদন খরচ কমে।
পঞ্চমত, ডিজেলের দাম কমানো। এখন এক লিটার ডিজেলে ২১ টাকার মতো শুল্ক–কর আসে। এ ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফাও কমিয়ে ধরা যেতে পারে। এতে পরিবহন খরচ কমবে, যা পণ্য সরবরাহে খরচ কমাবে।
ষষ্ঠত, সরবরাহ ব্যবস্থায় সংস্কার করতে হবে। বাজার তদারকি সফল করতে পাকা রসিদের ব্যবহার, লেনদেন আনুষ্ঠানিক করা, চাঁদাবাজি দূর করা ও বাজারগুলো থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করতে পদক্ষেপ দরকার।
সপ্তমত, দেশের বিভিন্ন নিত্যপণ্যের বাজার গুটিকয়েক কোম্পানি ও আমদানিকারকের দখলে। সেখানে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
অষ্টমত, পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও সরবরাহের পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য করা জরুরি। কারণ, সঠিক হিসাব না থাকলে সঠিক নীতি নেওয়া যায় না। সরকারি সংস্থাগুলো উৎপাদনের যে হিসাব দেয়, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দাম কেন বাড়ছে, তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করা দরকার বলে মনে করেন খুচরা ব্যবসায়ীরাও।
মিরপুর-১১ নম্বর কাঁচাবাজারের ডিম বিক্রেতা মোহাম্মদ মুনতাজের প্রশ্ন, প্রতিদিন কেন ডিমের দাম বাড়বে? মুরগির খাবারের দাম কত টাকা বেড়েছে?